স্বপ্ন সত্যি হয় না। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। অনেক কিছু প্রবাদ আমাদের সমাজে প্রচলিত। দিবা স্বপ্ন দেখা, যার কোনও মানে হয় না। আসলে মানুষের আকাঙ্ক্ষিত মনের ইচ্ছা, তার অবচেতন মনে দেখা দিলে, তাই স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। ভোরের স্বপ্ন মনে থাকে, গভীর রাতের স্বপ্ন মনে থাকে না এমন হয়।
এক স্কুল ছাত্রী ,যার জীবনে স্বপ্ন ছিল, একটা আশা খুব ধীরে ধীরে তার শরীরে ও মনে দানা বাঁধছিল। না-ছিল ভোরের স্বপ্ন, না গভীর রাতের, না দিবা স্বপ্ন। অতি প্রত্যুষ থেকে রাত অবধি একজনকে সামনে রেখে-দেখে কৈশোর মনে নানান কল্পনার বিন্দু গভীর সমুদ্রের মনে জড়ো হতে লাগছিল। কৈশোর থেকে যৌবনের দোলায় ঝাঁক ঝাঁক বিন্দু যখন মনের মনি কোঠায় লালিত- পালিত-শোভিত তখনই ছন্দ পতন ঘটেছিল এই মেয়েটির জীবনে। এই গল্পটি বলতে বসেছি আজ।
বর্ধমানের গলসি শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে এক গ্রাম মুনসিডাঙা। মুনসিডাঙায় অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলের যে শিক্ষিকা তাকে গলসি থেকেই প্রত্যেক দিন আসা যাওয়া করতে হয়। আজও তার উপস্থিতি স্কুলে। একদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের রান্নার আয়োজন, অন্যদিকে পড়াশোনাও চলছে। একটু পরেই ছেলে-মেয়েরা খেতে বসবে। খাওয়া-দাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ পড়া তারপর দুপুর বারোটায় ছুটি।

ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। শিক্ষিকাও বাড়ি ফিরতে উদ্যত। এমন সময় তার এনড্রয়েড ফোন বেজে উঠল। আন-নোন নাম্বার। ফোন ধরবে কি ধরবে না করে শেষ পর্যন্ত শিক্ষিকা ফোন ধরলেন।
—হ্যালো! কে বলছেন!
—হ্যালো! তুমি কি স্বপ্না?
—হাঁ। কিন্তু আপনি কে? চিনতে পারছি না তো।
—অবশ্যই! চিনতে না পারাই কথা। প্রায় এক যুগ পরে তোমার সাথে কথা বলছি। তবে আমার গলার স্বর চিনতে চেষ্টা করতে পারো।
—না…বুঝতে পারছি না। আপনি কে?
—আমি….পারহাটির, তোমাদের পাশের বাড়ির নীলদা।
—তুমি নীলদা…? এতদিন পরে হঠাৎ! কেমন যেন স্বপ্নার মন ছ্যাঁত করে উঠলো।
—কী ব্যাপার স্বপ্না? এবার চিনতে পারছো?
—হ্যাঁ, পারছি এবার। হঠাৎ এতদিন পরে কোথা থেকে?
—আমি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি। তাই দেশে ফিরে এসেছি। এখন থেকে দেশে, পারহাটিতেই আমরা থাকব।
—আর তোমার পরিবার।
—মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে চাকরি করে। আমরা দুজনে এখানেই থাকব। মাঝে মাঝে দরকার হলে ছেলে-মেয়ের কাছে যাব।
—আচ্ছা ভালো!
—তোমার কথা বলো। কোথায় থাকো। কোথায় বিয়ে হয়েছে তোমার?
—আমরা বর্ধমানের গলসিতে থাকি। আর কাছেই এক গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ির শিক্ষিকা।
—খুব ভালো। তুমি তো এমএ পাশ। তোমার বর কি করেন?
—ওর একটি কারপেন্টার শপ আছে।
—ভালো। তুমি বাপের বাড়ি পারহাটিতে এলে দেখা হবে। রাখছি।
দুই দিকের সেলুলার ফোন বন্ধ হয়ে গেল। স্বপ্নাও বাড়ির উদ্দেশে রওনা হল। কিন্তু ওর মন অন্যমনস্ক। এতদিন পর নীলদার ফোন, তার অতীতের ছবি সিনেমার পর্দায় আসা বারে বারে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তার তো কোনও দোষ ছিল না। তবে এই মুহূর্তে চোখে কেন ভাসছে নীলদা। ফেলে আসা সেই দিনগুলি। নীলদা, নীলদার মা জ্যাঠিমা, আরও অনেকে। নীরব চোখের ভালোবাসা, সমর্পন, সবই করাল বন্যায় ছিন্নভিন্ন হয়েছিল।
(ক্রমশ)