স্বপ্ন সত্যি নয়(২য় পর্ব): ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
(প্রথম পর্বটি পড়ুন)
বর্ধমানের মফস্বল পারহাটি, এক পাড়ায় নীল-স্বপ্নাদের বাড়ি। স্বপ্নার বাবা ছিল না। মায়ের উপর ভার সংসারের।
স্বপ্নারা দুই বোন এক ভাই। স্বপ্না,গীতা ও ভাই রাম। স্বপ্নার মা পারহাটি স্কুলের এসকটের কাজ করে। মেয়েদের স্কুলে পৌঁছানো আর ছুটি হলে নিয়ে আসা। এছাড়া পারহাটির অনেক মন্দিরের পূজার জোগাড়, রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে ওর মা। এইসব সাত-পাঁচ করেই স্বপ্নাদের সংসার চলে যায়। ওর দিদি গীতা কিছু সেলাই-ফোড়াই, টিউশন করে। ভাই রাম ছোট, প্রাইমারিতে পড়ে।
একই পাড়ায় নীলদের বিরাট বাড়ি। নীল এক মাত্র সন্তান। এ ছাড়া নীলের মা, বাবা, দাদু, ঠাকুমা, কাকা কাকিমাদের নিয়ে যৌথ পরিবার। এই পরিবারেই স্বপ্নার মায়ের অনেকদিন থেকেই আনাগোনা। নীলের মা স্বপ্নার মাকে বউমা বলে ডাকে। বউমাকে অনেক সময়েই নানান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বউমাও যতটা পারে নীলদের সঙ্গে সহযোগিতা করে। এমনি ভাবে বউমা তথা মায়ের সঙ্গে ছোট থেকেই নীলদের বাড়িতে আনাগোনা ছিল স্বপ্নার।
স্বপ্না তখন বছর বারো। ক্লাস এইটের ছাত্রী। একদিন নীলের ঠাকুমা স্বপ্নাকে বলল, “এই স্বপ্না, কাল থেকে এক সাজি পূজার ফুল আমাদের কৃষ্ণ-বলরামের মন্দিরে দিবি, তোর ডিউটি রইল।”
—”আচ্ছা ঠাকুমা।”
নীল আশেপাশে কোথাও ছিল, শুনে ছুটে এসে বললো, “স্বপ্না, তুইও আমাকে ফুল দিবি। গন্ধরাজ, গোলাপ বা জুঁই। আমার ফুলের গন্ধ শুঁকতে খুব ভাল লাগে।”
—”ঠিক আছে দেব। আমাকে লজেন্স দিতে হবে।”
দেওয়া-নেওয়া নিয়ে শুরু হয়েছিল নীল ও স্বপ্নার অজানা সম্পর্ক ছোট বয়স থেকেই। নীল ক্লাসের ভালো ছাত্র। প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম হত। নীলই ছিল স্বপ্নার প্রাইভেট টিউটর।
প্রত্যেক দিন স্বপ্না নীলের কাছে ক্লাসের অঙ্ক-ইংরেজি বুঝে নিত। ছিল খুনসুটি, নীল স্বপ্নার চুল টেনে দিতে। স্বপ্নাও ঠাকুমা, জ্যাঠিমাকে নালিশ করত।
—”দেখো না জ্যাঠিমা…, নীলদা চুল টেনে দিচ্ছে।”
—”এই নীল কি হচ্ছে, এবার বকবো তোকে…!”
ছিল বারো মাসে তেরো পার্বণ। লক্ষ্মী পূজা, কৃষ্ণের দোলযাত্রা,জন্মাষ্টমী, ঝুলন। আর সবেতেই নীলদের বাড়িতে বউমাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থাকতে হত পূজার জোগাড়ে, ভোগ রান্নায়। স্বপ্নার চলত সারা বাড়ি জুড়ে আলপনা দেওয়া। নীল এসে ওর আলপনা মুছে দিত। খুব ঝগড়া লাগত ওদের মধ্যে।
—”দেখো না ঠাকুমা, নীলদা আমার আলপনা মুছে দিল।

—”না, আমি মুছে দিইনি ঠাকুমা, ওর বন্ধুরা এসে মুছে দিয়েছে। এই চুপ কর…., তোকে আমার ভাগ থেকে ক্ষীরের বাটি, ফল-মূল সব দিয়ে দেবো।
—”ও…ঠাকুমা, কী সব বলছে দেখো…ক্ষীরের বাটি দেবে, আমার মুখ বন্ধ করার জন্য।”
সারা বছরই নানান পূজার আনন্দ, অন্যদিকে স্কুল, পড়াশোনা। এই বয়সে নীলদের বাড়ি ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারত না স্বপ্না। স্কুল থেকে এসে মায়ের কাছে জল-খাবার খেয়েই স্বপ্না ছুটত ঠাকুমার কাছে।
কিছুক্ষণ বকবক না করলে ঘুমই হত না।
চলতে চলতে, দিনে দিনে ওরা বয়সে-মনে বড় হতে লাগল। একদিন নীল স্কুলের পর্ব সাঙ্গ করে কলেজ হোস্টেলে চলে গেল। স্বপ্না ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠল। হঠাৎ স্বপ্না অনুভব করল কেউ তার পাশ থেকে সরে গেছে। যে তার একান্ত আপন। একটু উদাস, মনটাও হু-হু করতে লেগেছিল।
ঘটনা ঘটেছিল সেইদিন, যখন নীল দুর্গাপূজার ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল। অষ্টমীর দিন স্বপ্না নতুন শাড়ি পরে ঠাকুমা, জ্যাঠিমা, বাড়ির বড়দের প্রণাম করছিল। নীল ওকে হাত নেড়ে ওর ঘরে ডেকেছিল। স্বপ্না ঘরে যেতেই নীল ওর চিবুক স্পর্শ করে বলেছিল….,
—”স্বপ্না…কী সুন্দর লাগছে তোকে। আমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবি?”
স্বপ্না মুখ হেঁট করে সন্মতি জানিয়েছিল, মৌনতায় সারা জীবনের সঙ্গী হতে। শরীরে, মনে নীলের স্পর্শে শিহরণ খেলে গিয়েছিল। নীল আরও বলেছিল,”স্বপ্না তোকে না দেখতে পেলে আমার মন ঠিক থাকে না। মনে হয় বাড়ি ফিরে আসি। তুই শুধু আমার।”
সেই থেকেই স্বপ্না নীল একে অপরের কাছে এসেছিল।
কিছু কথা শেষ হয়ে গেলে সম্পর্ক ফুরিয়ে যায়। নীল পড়া শেষ করে চাকরি নিয়ে চলে যায়। সম্পর্ক…তার আগ্রহের অভিমুখ ধীরে ধীরে পালটে যায়। জীবনের গুরুত্ব বদলে যায়। কথা কমে আসে, সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছে যায়। স্বপ্নার জীবনের ঘটনা প্রবাহ সেইদিকেই মোড় নিয়েছিল। ঠাকুমা, বাবা-মা নীলের বিয়ে অন্য এক মেয়ের সঙ্গে সম্পন্ন করে। কেউ জানে না নীল-স্বপ্না, স্বপ্না-নীলের গভীর আত্মা। অন্ধকারে পাক খেতে থাকে তাদের ভালবাসার স্বপ্ন।
ছেলেবেলায় যে বন্ধু কে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, কতক্ষণে স্কুলে গিয়ে মনের কথা কলকল করে বলবে, সেই নীল এখন কোথায়! বদলে যায়, গুরুত্বের অভিমুখ বদলে যায়, কথা কমে যায়, সম্পর্কর সুতো ছিঁড়ে যায়।
যে ঠাকুমার সাথে ঘণ্টাখানেক বকবক না করলে রাতে ঘুম হত না, সেই ঠাকুমা তো এখন ইহ-জগতেই নেই। এখন গল্প না শুনেই শুয়ে পড়া। কথা নেই, মনে পড়াও নেই। মানুষগুলো কেমন যেন মুছে গেছে জীবন থেকে। স্বপ্নার রাগ, দুঃখ, কষ্ট অভিমান, আনন্দ আজ সব একাকার হয়ে গেছে। এখন সে মনের কথা মনেই রাখতে শিখেছে।
যাকে একসময় একান্ত আপন মনে হত, তার সাথে ফোনে কথা বলতে গেলে নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। দিন বদলে গেছে। কথা ফুরিয়ে গেছে। সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। স্বপ্নার স্বপ্ন সত্যি হয়নি।
(সমাপ্ত)