খুব কম বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছিল নীরা। তারপর থেকে কাকার কাছে মানুষ হয়েছে সে। কাকার তিন ছেলেমেয়ে, অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তার ওপর কাকার হাত ধরে নীরা যেদিন সে বাড়িতে পা রাখে সেদিন কাকিমা বিশেষ খুশি হননি। নীরার সামনে হয়ত তিনি সেদিন কিছু বলেননি কিন্তু দিন যত যেতে থাকে প্রতিনিয়ত তিনি তার ব্যবহারেই তা বুঝিয়ে দেন। কালের নিয়মে দিন এগিয়ে যেতে থাকে। এখন আর কাকিমার কথাতে কিছু মনে করে না নীরা।
বাবা, মা আর নীরাকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা সংসার ছিল। তাদের অভাব হয়ত ছিল কিন্তু আনন্দ ছিল অনেক বেশি। পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিল নীরা কিন্তু হঠাৎ একদিন তাদের সংসারে নেমে আসে শোকের ছায়া। নীরার বাবা হঠাৎ মারা যান। তারপর থেকে তার মা এই শোক সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এইভাবে দু’বছর শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকার পর তিনিও নীরাকে ছেড়ে চলে যান। তারপর কাকার হাত ধরেএই বাড়িতে আসা।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল নীরা, তারপর আর পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ নীরার বিয়ের একটি সম্বন্ধ আসে। তাদের খুবই পছন্দ হয় নীরাকে এবং তাদের কোনও দাবি-দাওয়াও ছিল না তাই নীরার কাকিমা খুব সহজেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন এই সম্বন্ধে। কাকা অবশ্য প্রথমটায় রাজি হননি কিন্তু শেষমেশ কাকিমার ওপর তিনি আর কিছু কথা বলতে পারেননি।

ছোট থেকেই নীরার স্বপ্ন ছিল সুন্দর একটা বাড়ির; যার সামনে থাকবে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। নীরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে প্রবেশ করে। কিন্তু নীরার শ্বশুরবাড়ি ছিল খুব ছোট্ট। সকলেই সেখানে খুব কষ্ট করে থাকত। তার ওপর ফুলের বাগান সে তো বিলাসিতা। তাই সেই স্বপ্ন আর পূরণ হল না তার। নতুন পরিবেশ নতুন লোকজন দেখে একটু ভয়ে ভয়ে ছিল সে কিন্তু ফুলসজ্জার দিন যখন সে নিজের ঘরে চুপ করে বসেছিল হঠাৎ সে চমকে ওঠে! তার হাতে যেন কে হাত রাখে, সে তাকিয়ে দেখে সে আর কেউ না তার স্বামী শুভ। সেই থেকে হাতে হাত রেখে পথ চলা শুরু দুজনের। এই বাড়িতে শুভ ছাড়া আছে তার অবিবাহিত দুই বোন আর মা। বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। তাই শুভর ওপরই সংসারের সব দায়িত্ব। এরপর দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকগুলো বছর।
আজ সকাল থেকেই নীরার বাড়িতে হইচই হচ্ছে, সানাইয়ের সুরে সারা বাড়ি গমগম করছে আর হবে নাই বা কেন আজ যে নীরা আর শুভর একমাত্র ছেলে দীপের বউভাত। নীরা অবশ্য বউমাকে পছন্দের সুযোগ পায়নি। কারণ তার ছেলেই পছন্দ করেছে বউমাকে। তারা একই অফিসে কাজ করে আর সেই সূত্রেই দুজনের পরিচয় আর তার থেকে হয় ভালবাসা; যার পরিণতি এই বিয়ে। তাতে অবশ্য আপত্তি ছিল নীরা আর শুভর। নতুন বউমা বাড়িতে আশায় খুব খুশি নীরা কিন্তু এই বাড়িটা বড্ড ছোট আর বেশ পুরনো হয়ে গেছে, নতুন বউমা এই বাড়িতে ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারবে তো মনে মনে ভাবে নীরা কিন্তু কীবা করা যাবে! শুভর সামান্য চাকরিতে অনেক কষ্টে তারা দীপকে মানুষ করেছে। তারপর আর বাড়ি বানানোর টাকা কোথায়? যা হবে দেখা যাবে এই বলে নীরা কাজে মন দেয়।
ছেলে বউমাকে নিয়ে বেশ ভালই দিন কাটছিল তাদের। হঠাৎ একদিন কানে কিছু কথা আছে এবং যা শুনে তার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যায়। একদিন রাতের বেলা নীরার কিছুতেই ঘুম আসছিল না তাই সে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিল। হঠাৎ তার বউমা ও ছেলের কিছু কথা তার কানে আসে, ওরা বলছিল যে এই বাড়ির ব্যাপারটা এখন মা-বাবাকে না-বলাই ভালো, পরে কোনও সময় বললেই হবে আর যাওয়ার দিন তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হবে।
অনেক ঝড় ঝাপটা, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ সুখের মুখ দেখেছে সে। ছেলেকে ভালোভাবে মানুষ করেছে কিন্তু এ কী কথা শুনল নীরা? সে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ তার কান্না শুনে শুভ ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল এবং তার কাছে জানতে চাইল কী হয়েছে? নীরা তখন যা শুনেছিল সেইসব কথা শুভকে বলল। শুভ তাকে অনেক বোঝাল আর বলল ছেলে এখন বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে এখন তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে তাই সে যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করবে এতে এত চিন্তার কী আছে?
“চিন্তা ক’রো না, ঘুমিয়ে পড়ো”— এই বলে শুভ ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু সারারাত ঘুমাতে পারল না নীরা। এর পর যত দিন যেতে লাগল এক অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল নীরার মন। সব সময় একটা চাপা কষ্ট তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। কাওকে কিছু বলতেও পারছিল না। বউমা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল তার কি শরীর খারাপ? কিন্তু নীরা কোনও না কোনও কথা বলে এড়িয়ে গেছিল।
এরপর একদিন বিকেলবেলা ছেলে ও বউমা আসে নীরার ঘরে এবং বলে, “মা তুমি আর বাবা কাল সকাল সকাল তৈরি থেকো আমরা একটা জায়গায় যাব।”
নীরার মন অজানা আশঙ্কায় ভরে যায়। দীপকে বলে, “কোথায় যাব রে?”
দীপ বলে, “চলই না, গেলেই দেখতে পাবে।”
আর কোন কথা বলতে সাহস পায় না নীরা। সেদিন রাতে সারারাত ঘুম আসেনা। মনে নানান চিন্তা আসে তবে কি তাদেরকে দীপ বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবে? আবার পরমুহূর্তেই ভাবে, না না তার ছেলে এমন কাজ কিছুতেই করতে পারে না। যাইহোক দেখতে দেখতে সকালবেলা সকলেই তৈরি হয়ে গাড়িতে ওঠে। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলে কিন্তু নীরা চুপচাপ গাড়ির ভেতর বসে থাকে। হঠাৎ গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সবাই গাড়ি থেকে নামে, নীরা যেন কিছুতেই নামতে পারছিল না গাড়ি থেকে। দীপ বলে, “কী হল মা?” বলে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায় নীরাকে। —”এটা কার বাড়ি রে খোকা?”
—”চলো না গেলেই দেখতে পাবে।” বলে দীপ।
তারা গাড়ি থেকে নামতেই একজন লোক একটি চাবি দীপের হাতে দেয়। তারপর তারা গেটের চাবি খুলে বাড়িতে প্রবেশ করে। বাড়িতে সামনে খুব সুন্দর একটা ছোট্ট ফুলের বাগান। এরপর দীপ সেই চাবিটা তার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলে, “এই নাও মা তোমার স্বপ্নের ঠিকানা, তোমার বাড়ি, তোমার নিজের বাড়ি। এটা আমি আর তোমার বউমা মিলে তোমার জন্য বানিয়েছি। আমি জানি তোমার অনেক স্বপ্ন ছিল একটা ছোট্ট বাড়ির। যার সামনে থাকবে একচিলতে ছোট্ট ফুলের বাগান কিন্তু সংসারের চাপে আর আমাকে মানুষ করতে গিয়ে সে স্বপ্ন তোমার পূরণ হয়নি, তাই আমি আর তোমার বউমা মিলে আজ তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ করলাম।”
নীরার দুচোখে নেমে আসে জলের ধারা। ছেলে বউমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে, আর মনে মনে ভাবে এই তবে তার স্বপ্নের ঠিকানা!
খুব সুন্দর ❤️