স্নেহময়ী – দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যায়

ছোট থেকেই নিয়ম এর বিপরীতে চলাই যেন ধর্ম দীপকের। ডানপিটে, প্রানচঞ্ছলতায় ভরা তার জীবন। কলকাতার নামকরা এক কলেজের গ্রামোন্নয়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে এখন। প্রাকৃতিক পরিবেশে স্নিগ্ধ শ্যামল গাছপালা আর বিভিন্ন অজানা জায়গার অভিনবত্ব তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে দেখতে চায় সেসব বিষয় স্বাআঙ্গিকে। কলেজের লিখিত পরীক্ষার পর ব্যবহারিক পাঠ্যক্ৰমের সূচি অনুযায়ী দীপক আর তার সহপাঠী তরুণকে তিন দিনের শিক্ষামুলক ভ্রমণে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাদের যেতে হবে সুন্দরবনের অচেনা একটি গ্রামে। সেই গ্রাম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে, সেখানকার মানুষদের জীবন-জীবিকা, চাষবাস সহ তাঁদের সামাজিক জীবনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় জানাই তাদের কাজ। যথারীতি দীপকের তো মন নেচে উঠল। উৎসাহে তার মন গেয়ে উঠল “পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।” তার অন্যান্য সহপাঠীরাও বিভিন্ন জায়গায় যাবে রুপসী বাংলার মাটির ঘ্রাণ নেবার জন্য। দীপকের উন্মাদনা যেন বাড়ি মাতিয়ে তুলল। যদিও দীপকের মা একটু উদ্বিগ্ন কন্ঠেই বললেন, “হ্যাঁ রে তোরা পারবি তো ওখানে গিয়ে একা একা থাকতে?”
-“মা আমরা বড় হয়েছি, ঠিক পারব, আর তাছাড়া এটা শিক্ষামুলক ভ্রমণ, তুমি অত চিন্তা করো না!”
বাবাও বললেন, “খুব সাবধানে যাবি আর যেখানে সেখানে চলে যাবি না যেন।”
যথারীতি যাবার দিন এসে গেলো।
যাবার আগের দিন রাতে তো দীপক ঘুমালই না, ফোন করে দেখল তরুণেরও সেই একই অবস্থা। উৎসাহের রাত পোহালে সোনারপুর স্টেশন থেকে ভোরবেলার ট্রেন ধরে তারা রওনা দিলো ক্যানিং এর উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে বাসন্তিগামী বাসে যেতে হবে জয়গোপালপুর এবং সেখান থেকে মাইল সাত দূরে তাদের গন্তব্য। দুই যুবক বন্ধু একরাশ আশা আর আবেগকে সাক্ষী রেখে সেই সুন্দরবন এলাকার নয়নাভিরাম প্রকৃতির শোভা অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। সময়টি একদম শরতের প্রাক্কাল, কাঁচা সোনালি আভায় প্রকৃতি তখন সুর্যস্নান করছে। মাতলা নদীর দু’পাড় জুড়ে কাশের বন সুদুর মেঘমল্লারের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত। তরুণ বলে উঠল, “বল দীপু, আজ এক অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে! সুধীরবাবু ক্লাসে বলতেন, চার দেওয়ালের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষের সাথে মিশে তাদেরকে আপন করে নেবার মধ্যেই তো আসল শিক্ষা,” দীপক বলল।
বাসের জানলা দিয়ে বাইরের উন্মুক্ত দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকা তরুণ সম্মতিসূচক উত্তর দিল।
গ্রামের শুরুতেই এক স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠীর অফিস লাগোয়া একটি ঘরে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। স্নান খাওয়া সেরে দুই বন্ধু যথারীতি সেই গ্রাম পরিদর্শনে বেরোলো। সেচ্ছাসেবক দলের কাছ থেকে তারা জানতে পারল গ্রামের শেষে একদল মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর বাস। দীপকরা ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে পড়ল। তাদের উদ্দেশ্য ওই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অবগত হওয়া। দুই অচেনা যুবককে দেখে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বরং আনন্দই পেল। দীপক রাও মিশে গেল তাদের সাথে।
“খোকাবাবুরা আসছেন কোথা থেকে গো, আমাদের এই গ্রাম দেখতে এয়েচেন বুঝি”- এক বৃদ্ধ তাদের জিজ্ঞেস করল।
দীপক বলল- “আমরা কলেজের ছাত্র আর শুধু তোমাদের গ্রাম দেখতেই আসি নি দাদুভাই, তোমাদের সাথে থাকেতেও এসেছি।”
-“তা থাকবে বই কি, এসো আমাদের ঘরের পানে “
আর একজন মধ্যবয়সি গ্রামবাসীর আমন্ত্রণে দুই বন্ধু চলল তার সঙ্গে। সূর্য তখন প্রায় অস্ত যায় যায়। দূর থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসছে আর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতার সাথে একটানা ঝিঁঝির ডাক দীপকের মনে এক মোহময়তার উন্মেষ ঘটাচ্ছে যা তার জীবনে প্রথম। এর আগে সে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে যদিও বেশ কয়েক বার। কিন্তু এই অনুভূতি তার জীবনে প্রথম। লোকটির নাম বিপুল মুণ্ডা। তার বাড়িতে ঢোকার সময় প্রথমেই ওদের চোখে পড়ল একজন মহিলা কাপড়ের পাড়ে কি যেন বুনছে। বিপুলকে জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারল ওই মহিলা বিপুলের স্ত্রী এবং সে ওই কাপড়ের পাড়ে চুমকি আর পুঁতি বসাচ্ছে। এখান থেকে সেটা বাসন্তী লাগোয়া শহরের হাটে বিক্রি করবে। গল্প আড্ডায় তাদের সাথে মিশে যেতে লাগল দীপকরা। ইতিমধ্যে গ্রামের অনেকেই তাদের সাথে আলাপ সেরে গেছে। তরুণ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল “আচ্ছা তোমরা মুণ্ডারি ভাষা বলো না?”
বিপুল বলল “সে সব আমার দাদুর আমলের কথা, তারা বলতে পারত, আমরা ওসব জানি না”।
কথায় আড্ডায় দীপকরা এটা বুঝতে পারল তারা মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর হলেও এখন তারা পুরোপুরি আধুনিক, তাদের সামাজিক রীতিনীতি এখন সাংস্কৃতিক অভিযোজনের পথে। ঠিক এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে বিপুলের বৃদ্ধা মা বেরিয়ে এসে বললেন-
“আমি মুণ্ডারি বলতে লা জানলেও কিছু পরবের কতা বলতে পারি যেগুলো আমরা এখানে করি।”
উৎসাহিত দীপক বলল আচ্ছা ঠাকুমা তুমি বলো। খোলা উঠোনে এক শরতের সন্ধ্যায় ওই বৃদ্ধার মুখে দীপকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল তাদের ভাদ্র মাসের করম উৎসবের কথা, বনদেবী উৎসবের কথা, সারহুল পরব, বিরসা মুণ্ডা গানের কথা। দীপকরা আরও জানলো কীভাবে ধীরে ধীরে এইসব উৎসব ওই এলাকায় হারিয়ে যাচ্ছে কালের সাথে সাথে। বিপুলের স্ত্রী রমলা দীপকদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখলেন না। দীপক অবাক হয়ে দেখতে লাগলো কীভাবে এই ছায়াঘেরা গ্রামের সরল মানুষগুলো অল্প সময়েই ওদের আপন করে নিল। রমলা যেন দীপকদের ছাড়তেই চান না।
রমলা বলল, “আজকে আমাদের বাড়িতেই থাকো, খাওয়াদাওয়া কর, আমাদের বাড়িতে তো সেরকম কেউ আসে না, তোমরা না হয় একটা দিন থেকেই গেলে।”
দীপকরা কথা দিলো সব কাজের শেষে ফেরার আগের দিন দুপুরের আহার এখানেই সারবে। আপ্লুত বিপুল আর রমলা আবেগতারিত হয়ে পড়ল। সেদিনের মতো বিদায় জানিয়ে ওরা ফিরে এলো যথাস্থানে। রাত্রে মায়ের কাছে গল্প করল দীপক। মোবাইলের যোগাযোগ এর সমস্যা থাকায় সবটা আর বলতে পারল না সে।
পরের দিন সকালে দুই বন্ধু কলেজের দেওয়া সব কাজ সেরে ফেললো আর ওখানকার মুণ্ডা গোষ্ঠীর সম্পর্কে পাওয়া তথ্যও লিপিবদ্ধ করল। এবার তাদের বাড়ি ফেরার পালা। প্রতিস্রুতি মাফিক তারা বিপুল মুন্ডার বাড়ি গিয়ে হাজির হল। তাদের আহারাদির ব্যবস্থাও ছিল বেশ জব্বর। বিপুল তার নিজের চাষ করা গলদা চিংড়ি আর শোল মাছ ধরল। দীপক আর তরুণ তো কোনওদিন এরকম মাছ চাষ করাই দেখেনি।
দীপক বলল- “ভাই তরুন চল বিপুলের সাথে জলে নেমে গলদা চিংড়ি ধরব।”
তরুন তো এককথায় রাজি। দুই বন্ধু প্রবল উৎসাহে জলে নেমে গলদা চিংড়ি ধরল। ঘরে ফিরে তারা দেখল রমলা পরিপাটি করে রান্না করছে।
রমলা বলল- “আজ বরং আর ফিরতে হবে না, গ্রামে আজ একটা যাত্রাপালা আছে সন্ধের দিকে, না হয় ওটা দেখে কাল চলে যেও।”
দীপক কেমন যেন আবেগতারিত হয়ে পড়ছিল।
যদিও দীপক বলল- “ইচ্ছে তো করেই কিন্তু আমাদের যে সময়ই নেই, তবে কথা দিলাম তোমাদের গ্রামে আমরা আবার আসব।”
গ্রামের অনেকেই ওদের সাথে দেখা করে গেলো। পরম তৃপ্তিসহকারে ওরা খেল চিংড়ি আর শোল মাছের ঝাল। পরম স্নেহময়ী রমলার আতিথেয়তায় মাতৃস্নেহ উছলে পড়ছিল যেন। এবার যাবার সময় উপস্থিত, শরতের আকাশে তখন মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা, শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর পড়ছে রমলার মুখে। মনটা ভারাক্রান্ত সবার, দীপক আর তরুণ দুজনেই এই অল্প সময়ে ওদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল ওদের অজান্তেই। মমতাময়ী রমলার চোখের কোণে কি যেন একটা চকচক করে উঠল। দীপকরা বাড়ির উঠান পেরিয়ে রাস্তায় এলো সাথে বিপুল আর বেশ কিছু গ্রামবাসী। যেন তাদের আপনজন তাদেরই ছেড়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে।
পিছন থেকে রমলার কণ্ঠরোধ হয়ে এলো- “আবার আসবি তো রে তোরা? আসিস বাবা, আমি তো তোদের আর এক মা-ই বটে।”
দীপক অপলক ভাবে বলল, “আসব আর তোমায় নিয়ে যাব আমাদের ওখানে”। তারপর ক্ষনিকের স্তব্ধতা। বিপুল বলে উঠল, “সেও বলেছিল আসবে, আর আসে নি, খোঁজও রাখেনি।”
দীপক নিচুস্বরে জিগ্যেস করল, “কে”?
পাসে দাঁড়িয়ে থাকা গতদিনের সেই বৃদ্ধ ধরা গলায় বললেন, “ওদের ছেলে।”
রমলাকে আর দেখা গেলনা সেখানে। একদল ঘরে ফেরা পাখি গোধূলির নিস্তব্ধতা খণ্ড করে দিগন্তে বিলীন হয়ে গেল। দূর থেকে যাত্রার গান ভেসে আসতে লাগল ” মা তোর কত রঙ্গ দেখব বল।”