সান্টাক্লজ: সুদীপা পাঠক
কয়দিন ধরে শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পরেছে। বিমলবাবুর বয়স প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। এই শীতেও রোজ ভোর সাড়ে চারটে-পাঁচটায় উঠে তিনি তাঁর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তাঁর বাগানের ফুল বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। বাড়িতে লোক বলতে তিনি, তাঁর স্ত্রী ও তাদের একমাত্র নাতনি। এই ফুল বিক্রি করে যে পয়সা রোজগার হয় তাতে কোনও মতে কষ্ট করে তাদের চলে যায়। বিমলবাবুর ছেলে ও বউমাকে গত বছর করোনা কেড়ে নিয়েছে। আর তারপর থেকেই তিনি এই সংসার আর নাতনির দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। বাজারে ফুল বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে আজ একটু দেরিই হয়েছে বিমলবাবুর। রাস্তায় আজ খুব ভিড় ছিল। তার উপর নাতনির জন্য তিনি একটি কেক কিনেছেন। কাল রাতে মেয়েটা খুব শখ করে তাঁর কাছে কেক খাবার আবদার করেছিল। বাড়ি ফেরা মাত্রই দাদুর সাইকেলের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে ছুটে আসে টুয়া—বিমল বাবুর নাতনি। বিমলবাবু টুয়ার হাতে কেকটা দিতেই সে আনন্দে লাফাতে লাফাতে তার ঠাম্মাকে বলে, “দেখো ঠাম্মা, দাদু আমার জন্য কী সুন্দর একটা কেক এনেছে।”
বিমলবাবুর দুই চোখে জল আসে, তিনি ভাবেন আজ যদি ওর বাবা-মা বেঁচে থাকত তাহলে সবার মতো ওকেও বড়দিনে কত কিছু কিনে দিত। রাতে বিছানায় শুয়ে টুয়া তার ঠাম্মার কাছে বায়না করে গল্প শোনার। সান্টাক্লজ়ের গল্প। তার ঠাম্মা মিনতিদেবী বলেন, “ওসব গল্প তো আমার জানা নেই দিদিভাই, তার চেয়ে তোমায় বরং রূপকথার গল্প বলি।”

টুয়া বলে, “না ঠাম্মা আমি ওই গল্পগুলো রোজ শুনি; আজ সান্টাক্লজ়ের গল্পই শুনব।”
বিমলবাবু তখন বলেন, “আচ্ছা দিদি ভাই আজ আমি তোমাকে গল্প শোনাব।” এই বলে তিনি গল্প বলা শুরু করেন।
তিনি বলেন, “সান্টাক্লজ় রাতে আসে আর সব বাচ্ছাদের উপহার দিয়ে যান।”
“তাহলে সান্টাক্লজ় আমাকেও উপহার দেবে দাদু?” ছোট্ট টুয়া জানতে চায়।
বিমলবাবু বলেন, “নিশ্চয়ই দেবে দিদি ভাই।”
—”তাহলে আমি সান্টাক্লজ়ের কাছে অনেক সুন্দর সুন্দর মালা, চুড়ি, এইসব চাইব। জানো দাদু আমার বন্ধুদের কাছে কত সুন্দর সুন্দর সাজের জিনিস আছে কিন্তু আমার কাছে কিছুই নেই তাই সান্টাক্লজ যদি আমাকে এইগুলো দেয় তাহলে আমিও সুন্দর করে ওদের মতো সাজতে পারব।”
বিমলবাবু মনে মনে ভাবেন কত ছোট্ট একটা চাহিদা কিন্তু সেটাও পূরন করার সাধ্যও তার নেই। নাতনিকে তো সান্টাক্লজ় উপহার দেবে কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে টুয়া যখন দেখবে কোনও উপহার নেই তখন কী হবে? সারা রাত ভালো করে ঘুম আসল না। পর দিন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠলেন বিমলবাবু। নিজের হাতে বাগান থেকে ফুল তুললেন। তারপর তিনি নিজের হাতে নাতনির জন্য সুন্দর সুন্দর ফুলের গয়না বানালেন। এরপর ধীরে ধীরে সেগুলো টুয়ার মাথার কাছে রেখে দিলেন। একটু বেলায় যখন টুয়া ঘুম থেকে উঠল তখন দেখল তার বিছানার পাশে কী সুন্দর ফুলের তৈরি মালা, চুড়ি। খুশিতে টুয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঠাম্মাকে সব দেখাল। ঠিক সেই সময় সাইকেল নিয়ে ঢুকলেন বিমলবাবু। টুয়া ছুটে গিয়ে দাদুকে বলল, “তুমি ঠিক বলে ছিলে দাদুভাই সত্যিই কাল রাতে সান্টাক্লজ় এসে আমার জন্য গয়না দিয়ে গেছে।”
আর দূরে রান্নাঘর থেকে দাদু নাতনির এই ভলোবাসা দেখে মিনতিদেবীর চোখে জল এসে গেল। ভেজা চোখে লাল জামা পরা আর গাল ভর্তি সাদা দাড়িতে ওই মানুষটিকে সত্যিই যেন তার সান্টাক্লজ় বলেই মনে হল।