শালপাতায় গরম গরম রুটি তরকারির মায়াময় মিলন– ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়

কী হচ্ছে কে জানে! বিশ্বব্রহ্মান্ডে প্রতিনিয়ত বিশাল দৈত্য ব্ল্যাক হোল আকাশে, মহাশুন্যে কোটি কোটি গ্রহাণু ধরে ধরে খাচ্ছে। আর পৃথিবীতে সাপ ব্যাঙকে, কমোড ড্রাগন কমজোর পশুদের, টিকটিকি গিরগিটি পোকাদের, আর সমাজের তথাকথিত বাহুবলী মানুষ, তারা অতি দরিদ্রদের অবিরত শোষণ করে চলেছে। বলশালী ধনী দেশ কমজোর দেশকে পায়ের তলায় রেখেছে। কিন্তু এই বছর যেন উল্টোপুরাণ। বিশ্বেশ্বর পুরো বিশ্বে ভাইরাস পাঠিয়েছেন, যা ধনী দরিদ্রকে সমান চোখে দেখছেন।
মাথার মধ্যে এইসব নানা রকম চিন্তা নিয়ে হাঁটছি, উত্তরপাড়ায় বি. কে. স্ট্রিট এর মোড় থেকে কাঁঠালবাগান রোডে প্রবেশ করলাম। পুরোনো আবাসিক শহর, রাস্তার পরিধি সরু, তাই ফুটপাত দিয়েই হাঁটা। ঠিক করলাম শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার পর্যন্ত হাঁটব…. তাহলে আমার রথ দেখা কলা বেচা দুই হবে, সময়ও কাটবে, আমি সচলও থাকব। বাবা লোকনাথ মন্দির অতিক্রম করলাম, আরও কিছু পথ, সহসা এক রিকশাওয়ালার ডাক, “বাবু পৌঁছে দেবো?”
না-না এই প্যানডেমিকে অ্যাভয়েড করা ভাল। সামনে অগ্রসর হতেই আবার, “বাবু!”
ঘাড় ফেরাতেই ওর চোখে চোখ পড়ে গেল, কেমন যেন উদাস, শান্ত, মলিন ও অর্ধভুখ; অথচ জীবনের প্রতিটি কষ্ট সে হাসি দিয়ে জয় করে ফেলেছে, অন্তর যেন বিরাট এক সমুদ্র, সূর্যের জোর নেই তাকে শুকিয়ে দেয়।
-“আচ্ছা চলো… কিন্তু…”
– “কিছু ভয় নেই বাবু, রিকশা আমার স্যানি করা আছে, কিছু হবে না আপনার।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে চলো, আমাকে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারে নামিয়ে দিও।”
-“আচ্ছা বাবু।”
সরকার লক আউট ঘোষণা করেছে, দোকানপাট খোলা, রাস্তায় তেমন গাড়ি-ঘোড়া দেখা যাচ্ছে না, মানুষজনও কম। চলেছি আমি, সামনে একজন লৌহ মানব, বজ্র কঠিন তার দুটি হাতে রিকশার হ্যান্ডেল ধরা। যাত্রী সুরক্ষায় তার চোখে তীব্র সতর্কতা, চুল থেকে পা পর্যন্ত মানবীয় ইঞ্জিনে রিকশা অবিরাম ছুটে চলেছে।
-“বাবু এসে গেছে নামুন।”
আগেই ২০ টাকা রেডি রেখেছিলাম। ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে যাব… রিকশাওয়ালা কিন্তু কিন্তু করে বলল, “বাবু কিছু যদি মনে না করেন, সামনের যদুভাজার দোকানে টাকাটা দিয়ে দেবেন?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন ভাই তুমি নেবে না?”
একটু চুপ করে রইলো সে, তারপর বলল, “কাল রুটি তরকারি জলখাবার খেয়ে পয়সা দিতে পারিনি… তাই, আজ …আপনিই প্রথম যাত্রী। সময় খারাপ… জানিনা আর যাত্রী পাবো কিনা… আগে কালকের ধারের জলখাবারের টাকা শোধ হোক… বলবেন দিনু রিকশাওয়ালা দিয়েছে।”
ধার শোধ… জলখাবারের ধার শোধ…।
জীবন যুদ্ধে তো সবাই সান্ত্বনা দেয়, লড়াই নিজেকে চালাতে হয়। বাস্তব এত কঠিন, বুকের ভেতর সব ভালবাসা, দুঃখ অসহায় হয়ে পরে।
-“দিনু অপেক্ষা করো, আমাকে আবার পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
দোকানে যাবার পর যদুবাবু একটু হাসলেন, তারপর টাকাটা নিয়ে বললেন, “দিনু ওইরকমই… আগে তাও খাবারের টাকা দু-এক দিন না দিয়েও থাকত… এখন যে আমার বিক্রি নেই, তাই ধার রাখতে চায় না… এই দেখুন না সকাল থেকে একটাও খদ্দের নেই।”
এ একটা অদ্ভুত অনুভূতি, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, অচেনা দিনু রিকশাওয়ালাকে বললাম, “চলো আজ এক সাথে খাই” শুনে দিনুর সে কি হাসি!
আর যদুবাবুরও, বেঞ্চে বসে একটা গোটা শালপাতায় গরম গরম রুটি তরকারি, ফাউ হিসেবে বোঁদেও ছিল। আমি ডিম ভাজার অর্ডার দিয়েছিলাম। ফেরার পথে, সেই লৌহ মানবীয় ইঞ্জিন রিকশার চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। শিরা যুক্ত অসুরের হাত, সম্মুখে তীব্র দৃষ্টি, যাত্রী সুরক্ষা, যে আবার ধার রাখতে চায় না…..২০ টাকার ধারও নয়।
নবতরু ই পত্রিকা এবং পত্রিকার এডমিনেশষ্ট্রেশন কে আমার আন্তরিক অভিনন্দন । আশাকরি নবতরু ই পত্রিকা সমৃদ্ধির আকাশ স্পর্ষ করবে এই কামনা করি ।
,সত্যিই মায়াময় মিলন। গল্পটা আগে পড়া হয়নি। দেখার চোখ,ভাবনার প্রসারতা আর লেখার কলম একসাথে মিতালি গড়লে সৃষ্টি অনবদ্য হতে বাধ্য। দিন রিক্সাওয়ালার চরিত্রটি দেখে আমার নিজের অনেক শিক্ষা হলো।দিনুর কুড়ি টাকা পরিশোধের দায়বদ্ধতা কর্পোরেটদের কবে শিক্ষা দেবে?