শান্তিনিকেতনের দিনিলিপি—২য় পর্ব: শ্রীবাস বিষ্ণু
এবার শান্তিনিকেতনে গ্রীষ্মের দাপট তেমন বোঝা যায়নি। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াসের’ প্রভাবে মে মাসের ২৪ তারিখ থেকে টানা তিনদিন শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে মেঘের ঘনঘটা, ঝোড়ো হাওয়া, কখনও গুড়িগুড়ি কখনও বা ভারী বৃষ্টি । উতল হাওয়া বাদল ধারায় স্নাত শান্তিনিকেতন, আগাম বর্ষার আভাস। ভরপুর গ্রীষ্মে ‘ইয়াসের’ প্রভাবে ভিজে ঝোড়ো হাওয়ায় আশ্রমের গাছপালাগুলিতে খুশির পরশ, তাদের দু-একটার মোটা ডাল ভেঙেছে। গোটা জুন মাস মেঘ ও বৃষ্টির আনাগোনায় বুঝতে অসুবিধা হয়না ‘ইয়াসের’ হাত ধরেই শান্তিনিকেতনে আষাঢ়ের(বর্ষার) আগমন ঘটেছে। এখন সারা আকাশ জুড়ে বাদল মেঘে মাদলের সুর। কদমের সুবাস আশ্রম প্রাঙ্গণে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। পুরনো মেলারমাঠ, ছাতিমতলা, আশ্রমমাঠ জুড়ে সর্বত্র সবুজের গালিচা পাতা। করোনা আবহে বহুদিন বিশ্বভারতী বন্ধ থাকায় আশ্রমের পথঘাট, দপ্তর, হোস্টেলগুলির চারপাশ সবুজ ঘাসের জঙ্গলে ঢাকা। চারিদিক বড়ো শ্রীহীন। এ-বছর ভালো বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টির জলে হাতিপুকুর তেমন ভরেনি। সে প্রান্তে খেলার মাঠ ইঁটের ফেন্সিং-এ ঘেরা থাকায় হাতিপুকুরে বৃষ্টির জল ঢোকার পথ বন্ধ। পূর্বে গুরুপল্লী এবং খেলার মাঠের বৃষ্টির জল হাতিপুকুরে ঢুকত। রায়পুরের সিংহরা জলাভাব দূর করতে যে তিনটি বড়ো বাঁধ(ভুবনডাঙা সংলগ্ন) বানিয়েছিলেন যেখানে বর্ষার জল টলমল করত সেখানেও বৃষ্টির জলের প্রবেশ ঘটেনি, পরিবর্তে এখন বাঁধগুলি সবুজ কচুরি পানায় ভর্তি। এক সময় বর্ষায় পূর্বপল্লী মাঠের, আশ্রমের বিভিন্ন প্রান্তের জল পাগলের মতো বিভিন্ন নালা লকগেট দিয়ে বয়ে বাঁধে ঢুকত। শান্তিনিকেতনের চারপাশ ইঁটের ঘেরাটোপে বদ্ধ হওয়ায়, জল নিকাশি ব্যবস্থা আজ ব্যহত।

এখন শান্তিনিকেতনের আকাশে রোদের দেখা মিললেও অধিকাংশ সময় আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। মাঝে মাঝে মাঝারি থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। ঘরে বসে উদাসী মনের ভাবনা, ‘এমন দিনে তারে বলা যায় ঘন ঘোর বরিষায়’। শান্তিনিকেতনের চারপাশের গাছপালা, পথঘাট, খোয়াই, মাঠ, নদী ঘিরে বর্ষার প্রাকৃতিক রূপের একটা ভিন্ন সৌন্দর্য আছে, তার একটা আলাদা ভাষা আছে। সামনে শ্রাবণ মাস, অবিশ্রান্ত শ্রাবণ ধারায় আকাশে বাতাসে বিরহের সুর। পল্লীর প্রাঙ্গণে গান উঠবে―
“আজ বারিঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে, / আকাশ ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে।।
শালের বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে, /
জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে মাঠের ‘পরে।”
রাত দিন বৃষ্টির জলে বকুলবীথি, গৌরপ্রাঙ্গণ জলে থৈ-থৈ করবে। ইস্কুল খোলা থাকলে সকালে প্রার্থনার পর ছেলেমেয়েরা বায়না ধরবে ‘ছুটি ছুটি, ছুটি চাই’। কোপাই নদী শ্রাবণ মেঘের জল বাতাসে মাতোয়ারা হয়ে পাগলের মতো দুকূল ছাপিয়ে বইবে। বিরহে আচ্ছন্ন ভাবুক প্রেমিকের মন গানে আসবে , “আমার প্রিয়ার ছায়া আকাশে আজ ভাসে……বৃষ্টি সজল বিষন্ন নিশ্বাসে…।”
এখন জুনের শেষ, বিশ্বভারতীতে গ্রীষ্মাবকাশ। স্কুল কলেজ বন্ধ। ১লা জুলাই সমস্ত বিভাগ খোলার কথা। এবছর জুন মাসের প্রথম দিকে পাঠভবন শিক্ষাসত্রের ভর্তিপক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পাঠভবনের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক অনলাইনে পরীক্ষা হবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। করোনার দাপট কিছুটা কমলেও ইতিমধ্যে সে শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আপনজনের বিয়োগ ব্যথার দীর্ঘশ্বাস শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন পল্লির আনাচে কানাচে। করোনার কারণে আজ শিশু যুবা থেকে বয়স্ক সব শ্রেণির মানুষ মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত। সকলেই আবদ্ধ ঘরে এক নিরানন্দময় জীবন কাটাচ্ছেন। সেই অবসাদ কাটাতে সম্প্রতি বিশ্বভারতী সংগীতভবনের উদ্যোগে অন্লাইনে মিউজিক থেরাপির ব্যবস্থা করেছেন। যন্ত্রসংগীত, উচ্চাঙ্গসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, কীর্তন, নাচ মনোরঞ্জনের সব ব্যবস্থা থাকবে। শান্তিনিকেতনে অসুস্থ বর্তমান ছাত্রছাত্রী কর্মী-অধ্যাপকদের অক্সিজ়েনের প্রয়োজন মেটাতে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে পিয়ার্সন মেমোরিয়াল হাসপাতালে একটি অক্সিজ়েন পার্লারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। করোনার আবহে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষিকা শতরূপা ঘোষ, মধুমিতা ভট্টাচার্য এবং নিবেদিতা সেনগুপ্তা গোয়ালপাড়া গ্রামে সংক্রমিত করোনা রোগীদের ঘরে বিনামূল্যে ‘দিদিমণির রান্নাঘর’ থেকে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। এসময় স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. অভিজিৎ চৌধুরীর সংগঠন ‘লিভার ফাউন্ডাশনের’ উদ্যোগে মুমূর্ষু করোনা রোগীর বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব শান্তিনিকেতন নিবাসী শিক্ষিকা, সমাজসেবী মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ন্যস্ত হয়েছে। করোনার কঠিন সময়ে তাঁর সংগঠন কৃতিত্বের সঙ্গে নানা জনহিতকর কাজ করে চলেছে। সামনে অগস্ট মাস, রবীন্দ্র তিরোধান দিবস বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ, রবীন্দ্রসপ্তাহ, শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব পালিত হওয়ার কথা।
(শান্তিনিকেতন জুন, ২০২১)