শুভ নববর্ষ ১৪২৯। বাংলা নূতন বছরে আমাদের একমাত্র প্রার্থনা আগামী বছরের দিনগুলি সকলের কাছেই যেন আনন্দমুখর হয়ে উঠে। কামনা করি, শুভ হোক নূতন বছর। আজ দিনলিপি লেখার পূর্বে ১৯৪০ সালে নববর্ষ উপলক্ষে প্রত্যুষে শান্তিনিকেতন মন্দিরে উপাসনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষণের কিছু অংশ স্মরণ করি। সেদিন কবি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “…… বৎসরে প্রথম প্রভাতের মধ্যে যে উপদেশ রয়েছে তাকে আমি আমার জীবনে কখনও উপেক্ষা করিনি। … প্রভাতে ঘুম থেকে জেগে চোখ মেলে দেখি বিধাতার এ এক আশ্চর্য্য বিধি ! প্রতিদিন প্রভাত আসে নতুন করে, প্রতিদিন নবজীবনের রাজ্যে প্রভাতের অবগুন্ঠন-মোচন—এ এক বিস্ময়ের বস্তু। এই নিরন্তর জাগ্রত ধারা যদি না থাকত তবে প্রতিদিনের পুঞ্জীভূত জড়তার আবর্জনায় পৃথিবীর এই ক্ষেত্রকে আচ্ছন্ন করে ফেলত, প্রতিদিনের ক্লান্তি আমাদের অভিভূত করে তুলতো; কিন্তু প্রতিদিনই বৎসরারম্ভের দিন তাই প্রতি প্রভাতের আলোকে আমাদের ক্লান্তি নৈরাশ্য দূরীভূত হয়। প্রতিদিনের সূর্য্যোদয় এই নবীনতার প্রকাশকে বহন করে আনে। তবুও মানবের চিত্ত একটি বিশিষ্ট দিনের আগমনের অপেক্ষা করে, ——সেদিনটি কালের মধ্যে চিহ্নিত করতে চায় বিশ্ব সংসারে, সেই চিরনবীনের আনন্দরূপ জীবনে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে, ধ্বনিত করতে আজ আমাদের এই নববর্ষের উৎসব, তার এই বার্তা —নবীনের আনন্দরূপের মাঝখানে তোমার প্রাণকে পূর্ণ করে নাও, যা জীর্ণ দীর্ণ প্রাচীন তাকে সরিয়ে ফেলো।”
মন্দিরে গান ওঠে, জীর্ণ যা-কিছু যাহা-কিছু ক্ষীণ / নবীনের মাঝে হোক তা বিলীন—-/ ধুয়ে যাক যত পুরানো মলিন/ নব-আলোকের স্নানে।।
খুশির খবর বহু প্রতীক্ষার পর বিশ্বভারতীর সব বিভাগ খুলেছে। মৃণালিনী আনন্দপাঠশালা থেকে পাঠভবনের প্রাথমিক স্তরের ক্লাস এপ্রিলের আঠারো তারিখ থেকে শুরু হয়েছে। অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস আগেই খুলেছিল। বিদ্যালয় স্তরে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অফ লাইনে বিশ্বভারতী ভাষাভবনে যথারীতি চলছে। রবীন্দ্রপ্রদর্শশালা রবীন্দ্রভবন খোলায় রবীন্দ্রানুরাগী পর্যটকদের ভীড় চোখে পড়ার মতো। সব দেখে মনে হয় শান্তিনিকেতন পুরনো ছন্দে ফিরছে। এদিকে তীব্র দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাপমাত্রার পারদ ৪০ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ছুঁয়েছে। পূর্বে দু-একদিন বৃষ্টিবাদল হলেও বহুদিন কালবৈশাখির দেখা নেই।

করোনা আবহে এ বছর বিশ্বভারতী বসন্ত-উৎসব ফাল্গুন মাসে করা যায়নি। দোলপূর্ণিমার দিন বসন্তউৎসব পালনের যে রীতি ছিল তা সম্ভব নয় সে কথা বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল। বিগত ১৩ এপ্রিল চৈত্রের শেষ লগ্নে বিশ্বভারতী ‘বসন্ত-বন্দনা’ নাম দিয়ে পালন করল বসন্ত-উৎসব। বলা যায় অকাল বসন্ত-উৎসব। অকাল বসন্ত হলেও সে দিনের সকাল বেলাটি ছিল আশ্চর্যজনক ভাবে সুন্দর। প্রকৃতির অকৃপণ ভালোবাসা এখনও যে মানবজীবনে প্রবহমাণ সেকথাটাই সেদিন মনেহচ্ছিল। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সকাল ও চড়া রোদের পরিবর্তে সকালবেলায় আকাশে খন্ড খন্ড কালো মেঘের যাওয়া আসা, মৃদুমন্দ শীতল বাতাস, পাখির কূজন, ছায়া ঘেরা আশ্রম সব মিলে এক মিষ্টিমধুর প্রাকৃতিক পবিবেশে সিক্ত হয়েছিল উৎসব প্রাঙ্গণ। ‘মেঘ-ছায়ে সজল বায়ে মন আমার উতলা করে……।’ শেষ বসন্তে মেঘের ছায়ায় মনে ভালোবাসার পরশ। অনুষ্ঠানে বহিরাগতদের প্রবেশের অনুমতি ছিল না। এমনকি স্থানীয় আশ্রমিক, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী কর্মীদের ক্ষেত্রেও একই বিধিনিষেধ। যদিও ওই দিন সন্ধ্যায় বিচিত্রানুষ্ঠানে প্রবেশ অবাধ থাকলেও দর্শকদের ক্ষেত্রে সাদা পোষাক ছিল নির্দিষ্ট। সকালে বসন্ত- বন্দনার নিয়ম রক্ষার অনুষ্ঠানে দর্শক সমাগম বেশ কম। কেবল সীমিত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক কর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তারমধ্যে শালবীথি জুড়ে বাঁশের ব্যারিকেট, বসার জন্য বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রঙিন প্লাস্টিক, কালো প্লাস্টিকে ঘেরা গৌরপ্রাঙ্গণ তাতে উৎসবে নান্দনিকতার অভাব প্রকট হয়েছে। অনেকে মনে করেন দোলপূর্ণিমার দিন শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব পালনের পরিকল্পনা বাতিল হলে পুরনো ধারা মেনে অনুষ্ঠানটি আম্রকুঞ্জে হলেই ভালো হত। কারণ পূর্বে অধিক দর্শক সমাগমের কথা ভেবেই একসময় বসন্ত-উৎসবের অনুষ্ঠান স্থল আম্রকুজ্ঞ থেকে গৌরপ্রাঙ্গণে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ‘বসন্ত-উৎসবের’ ইতিহাস আশ্রমের আদিকাল থেকে। এ দিন বিশ্বভারতী বসন্ত উৎসবের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ধারা অনুযায়ী অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন। সকালে শালবীথির পথে ‘ওরে গৃহবাসী খোল্ দ্বার খোল্’ গানের সঙ্গে নৃত্যের শোভাযাত্রা এবং পরে গৌরপ্রাঙ্গণ মুক্তমঞ্চে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবনের ছাত্রছাত্রীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিতর দিয়ে বসন্তের গান ও নাচে ‘ঋতু-উৎসবের’ আয়োজন করা হয়েছিল । হঠাৎ করে শান্তিনিকেতনে প্রধান ঋতু-উৎসব ‘বসন্তউৎসবের’ বদলে উৎসবের নাম ‘বসন্তবন্দনা’ কেন দেওয়া হল তার কারণ বোঝা যায়নি। বিগত দু-দশক বা তার কিছু পূর্ব থেকে বসন্ত উৎসবের আগের দিনে সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতন কর্মীমন্ডলীর ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ‘বসন্তবন্দনা’ নামক একটি অনুষ্ঠান। শান্তিনিকেতনে ‘বসন্ত-বন্দনা’, মূলত রবীন্দ্রসংগীতের আসর। যদিও বছর দু-এক আগে ওই দিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘সুন্দর’ নামে রবীন্দ্রনাট্যগীতি। কাজেই বসন্তউৎসব এবং বসন্তবন্দনা শান্তিনিকেতনে দুটি পৃথক অনুষ্ঠানবসন্ত-বন্দনার সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গণ মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে গান নাচের বিচিত্রানুষ্ঠান। নববর্ষের সন্ধ্যায় ওই মঞ্চে শিক্ষাসত্রের ছাত্রছাত্রীরা সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ গীতি-নৃত্যনাট্য ।
রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে রবীন্দ্রজন্মোৎসবের পূর্বেই আশ্রমে গরমের ছুটি পড়ে যেত। ছুটিতে ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মী অনেকেই বাড়ি চলে যেতেন। তাঁদের সকলের দুঃখ আশ্রমে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাঁরা যোগ দিতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবমতো ১৯৩৬ সালে নববর্ষের দিনে বর্ষবরণ এবং রবীন্দ্রজন্মোৎসব একত্রে পালনের সূচনা হয়। সকালে মন্দিরে বর্ষবরণের উপাসনা এবং পরে আম্রকুঞ্জে কবির জন্মদিনের উৎসব। নববর্ষ উপলক্ষে জলযোগেরও ব্যবস্থা থাকত। সেই ধারাটিই এত বছর প্রবহমাণ ছিল। বিগত বছর কয়েক হল বিশ্বভারতী তার কঠিন নিয়মতন্ত্রের বেড়াজালে গ্রীষ্মের ছুটি মে মাসের মাঝামাঝি করে দেওয়ায় নববর্ষে ‘রবীন্দ্রজন্মোৎসব’ অনুষ্ঠানটি আশ্রমজীবন থেকে বাদ পড়ে যায়। পরিবর্তে নববর্ষে মন্দিরে বর্ষবরণের ‘উপাসনা’ এবং পরে শালবীথি প্রাঙ্গণে ‘বর্ষবরণ’ নামে দুটি পৃথক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে আসছে। নববর্ষে রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালিত না হওয়ায় প্রাক্তনী এবং প্রবীন আশ্রমিকদের কাছে বিষয়টি গভীর দুঃখের কারণ নববর্ষ উপলক্ষে বর্ষবরণের উপাসনা এবং রবীন্দ্রোজন্মোৎসব পালন যা শান্তিনিকেতনবাসীদের কাছে গর্বের এক নিজস্ব ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছিল। নিজের জন্মদিনের উৎসবে ওই দিন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকতেন এবং নববর্ষ উপলক্ষে রবীন্দ্রজন্মোৎসব একমাত্র শান্তিনিকেতনেই পালিত হত। এমন একটি ঐতিহ্যবাহী রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত অনুষ্ঠান শান্তিনিকেতনের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল। পূর্বে নববর্ষে রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালিত হলেও ২৫শে বৈশাখ ভোরে উত্তরায়ণে কবিকন্ঠ, সকালে উপাসনা এবং রাত্রে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিশ্বভারতীর কর্মীমন্ডলির পরিচালনায় সম্পন্ন হত। যদিও এখন পঁচিশে বৈশাখে উপাসনা থেকে নানা অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালিত হয় কিন্তু পঠনপাঠন ছাড়া বিশ্বভারতীর সমস্ত বিভাগ খোলা থাকে।
বিশিষ্ট অধ্যাপক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণ সভা বোলপুরে জামবুনির উৎসব সভাঘরে স্মৃতিচারণ, গান, পাঠ ও সংস্কৃত মন্ত্র সহযোগে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়েছে। বিগত বসন্ত পূর্ণিমার দিন তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেছেন।
শ্রীবাস বিষ্ণু
শান্তিনিকেতন
২০ এপ্রিল, ২০২২