শান্তিনিকেতনের পরিবেশ এখনও অশান্ত; ‘অশান্তনিকেতন’ বললে ভুল বলা হবে না। দাবিদাওয়া নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘট চলছে। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পরীক্ষা হচ্ছে না। হয়তো পরীক্ষা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রশাসনিক আলোচনার মাধ্যমে এই জটিল পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসার কোনো ইঙ্গিত নেই। ইতিমধ্যে বিশ্বভারতীর কর্মসচিব-সহ দু-একজন অধ্যাপক সমস্যা সমাধানে অপারগ হওয়ায় তাঁরা কর্মসমিতির দ্বায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরের ক্লাস বন্ধ। শিশুরা দিনের পর দিন ঘরে বসে অন-লাইন ক্লাস করে ক্লান্ত। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অথচ রাজ্যের সর্বত্র প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত ক্লাস চলছে। শোনা যায় প্রায় দুবছর ধরে পর্যবেক্ষণের অভাবে ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাসগুলি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে। তাই আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের থাকা নিয়ে জটিলতা। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত মতে আপাতত তাদের বাইরে বাড়িভাড়া করে পরীক্ষায় বসতে হবে এবং ক্লাস করতে হবে। স্থানীয়দের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যেভাবে তড়িৎ গতিতে প্রাচীর উঠেছে, অধিক তৎপরতায় ফটক নির্মাণ হয়েছে, সাধারণের যাতায়তে বাধা দেওয়া হয়েছে— সেখানে বিশ্বভারতীর মতো আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাসগুলি দিনের পর দিন অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে কেন? যেখানে প্রত্যেক ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাসের জন্য বিশ্বভারতীর স্থায়ী কর্মী আছেন। বিশ্বভারতী খোলার পর কেন্দ্রীয় দপ্তর, ভবনগুলি খোলা থাকলে ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাসগুলির দিকে নজর দেওয়া হয়নি কেন? বোলপুর-শান্তিনিকেতনের আপামর জনসাধারণ চাইছেন এই জটিল পরিস্থিতি থেকে বিশ্বভারতী বেড়িয়ে আসুক। রবীন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসুক। প্রবীন আশ্রমিকদের কারো কারো মতে দাবিদাওয়া নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা দিনের পর দিন পথে অথচ আশ্চর্যজনকভাবে প্রশাসন নিশ্চুপ, এ রকম ঘটনা শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে নজীরবিহীন।
এ বছর মার্চের ১৮ তারিখ দোল পূর্ণিমায় রাজ্যের সর্বত্র দোল উৎসব পালিত হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে কোথাও কোথাও শান্তিনিকেতনের ধারায় পালিত হয়েছে ‘বসন্তোৎসব’। প্রকৃতির কবি রবীন্দ্রনাথ। তিনি সুন্দরের উপাসক। তাঁর গানের রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছে যাই প্রকৃতির রংমহলে। শীতের বিদায় বেলায় যখন দেখি গাছে গাছে নব কিশলয়ের আগমন, চারিদিকে কোকিলের কুহুতান, মৌমাছির গুঞ্জন, তখন শিরীষ-বকুল, আমের-মুকুল হাতে ডালি সাজিয়ে কার প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত? তা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে ওরা কার কথা কয়? নীল দিগন্তে কেন ফুলের আগুন লাগল? কে রং ছড়ালো বনে বনে? প্রদীপশিখা উতল দখিন হাওয়াকে কেন বলছে তুমি ধীরে ধীরে বও? এ সব প্রশ্নের উত্তর মেলে যখন দেখি বাতাসে তার আগমনের আভাস পেয়ে কবি গান ধরেছেন, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। ঋতুরাজের আগমন সংবাদে প্রকৃতির রংমহলে উৎসবের সাড়া। আনন্দ ও সুন্দরের প্রকাশ চারিদিকে। ফাগুনের নবীন আনন্দে মানব মনে প্রেমের দোলোন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে নবীন কুঁড়ি মেলে চায়। আর তাই নিয়ে রঙে রসে কল্পনার জাল বোনা, ধরার চিত্ত হয় উতলা।
বসন্তকালে দোলপূর্ণিমায় বাংলার গ্রামে গঞ্জে শহরে পালিত হয় দোল-যাত্রা। শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস গেয়ে ওঠে “ওরে গৃহবাসী, খোল, দ্বার খোল লাগলো যে দোল।”
ভালোবাসার আবিরে, রঙে রসে মানবমনে প্রেমের আনন্দলহরী। শান্তিনিকেতনে এ দিনটি ঋতুরাজ বসন্তকে আবাহন করার দিন, নাচে-গানে আনন্দতানে ‘বসন্ত উৎসব’। শান্তিনিকেতনে প্রথম দিকের এক বসন্তোৎসবে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ছিলেন তাঁর গানের ভান্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অধ্যাপকবৃন্দ, আশ্রমিক ও ছাত্রছাত্রীরদল। সকলেই বাসন্তী রঙের পোশাকে সুসজ্জিত। রবীন্দ্রনাথও বাসন্তী রঙের পোশাক পরে মধ্যমণি হয়ে তাঁদের মধ্যে বসেছিলেন। সে বার উৎসব স্থল ছিল কলাভবন প্রাঙ্গণ। সেদিন তাঁর রচিত ফাল্গুনী নাটকের গানগুলি গাওয়া হয়েছিল। তখন উৎসবে নাচের আগমন হয়নি। গান-নাচের মিলন ঘটেছে তার কিছু পরে, উৎসবের পর আবির খেলা তখনও চালু হয়নি।
বিগত তিন বছর ধরে করোনার কারণে দোল-পূর্ণিমার দিনে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব হয়নি। বিগত বছরের মতো এ বছরও বিশ্বভারতী এই দিনটিতে বসন্তোৎসব পালন না করে অন্য কোনো একটি দিনে এই ঋতু উৎসব পালন করবে বলে জানিয়েছে। বছর তিন পূর্বে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ দর্শণার্থীর সমাবেশ হয়েছিল কবিতীর্থে। সে দিন মানুষের উন্মাদনা, কিছু জনতার উশৃংখল আচরণ, মানুষের ভিড়ে ঠাসা রাস্তা-ঘাট, পদপিষ্ট হবার ভয়ে মানুষের আর্তনাদ সব মিলে এক ভয়াবহ পরিবশের সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয় সেই স্মৃতি দোলের দিন শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব না হবার কারণকে উস্কে দিয়েছে। রবীন্দ্রশিক্ষাদর্শের অঙ্গ শান্তিনিকেতনের উৎসব অনুষ্ঠান, আলাদা নয়। বিশ্বভারতীকে বাঁচাতে গেলে চাই শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ।
কিন্তু এ বছর শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব না হওয়া সত্বেও দু-তিন দিন ধরে বোলপুর শান্তিনিকেতনে যে জনসগাম হয়েছিল তাতে একটা ছবি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে— শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব না হলেও দোল উৎসব ঘিরে মানুষের আবেগ উন্মত্ততায় কোথাও কম পড়েছে বলে মনে হয়নি। পলাশ-নিধন যজ্ঞে ভাটা পড়েনি। হোটেলে হোটেলে পর্যটকের ভিড় সেখানে আবির খেলা গানের আসর, রাস্তা-ঘাট জুড়ে অটো, গাড়ি-সহ মানুষের ভিড়, মাত্রাতিরিক্ত অটোভাড়া দুর্বিষহ জনজীবন।

বসন্ত পূর্ণিমার দিনে প্রবীণ আশ্রমিক বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরলোকগমনের খবরে শান্তিনিকেতনে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘ পারিবারিক সম্পর্ক। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর তাঁর পিতামহ রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্রমের হিসাবরক্ষক হয়ে কাজে যোগ দেন। সকলেই জানেন আশ্রমে বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ আশ্রম বিদ্যালয়কে কিছুদিনের জন্য শিলাইদহে স্থানান্তরিত করেছিলেন। সে সময় গ্রীষ্মাবকাশ থাকায় আশ্রমে লোক সংখ্যা নেই বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথও আশ্রমের বাইরে। আশ্রমের শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এক ভৃত্য তাঁর সেবা শুশ্রুষা করেন। যদিও সতীশচন্দ্র বসন্ত রোগে মারা যান। ‘বনবানী’ গ্রন্থে ‘শাল’ কবিতায় কবির শোকের প্রকাশ ঘটেছে। সোমেন্দ্রনাথের পিতা সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিল্পী, ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতা গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন কলাভবনের প্রথম যুগের ছাত্র। অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথের আপন মামাতো বোন রবীন্দ্রস্নেহধন্যা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অধ্যাপিকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর লাগোয়া চূয়ামসিনা গ্রামের এক বর্ধিষ্ণু সাংস্কৃতিক পরিবারে সোমেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর শৈশব কেটেছে করাচিতে। পরে কলকাতা ও বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবন ও বিদ্যাভবনে অধ্যয়ন, গবেষণা। সে সময় তাঁর স্বনামধন্য শিক্ষকদের সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল। কিছু বৎসর কলকাতার আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। কলকাতা, রবীন্দ্রভারতী-সহ দেশ বিদেশে বহু সম্মানের অধিকারী, এমন একজন প্রবীণ অধ্যাপকের প্রয়াণ সকলের কাছেই এক অপূরণীয় ক্ষতি। অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথের প্রয়াণে শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনে একটি যুগের অবসান হল। তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এবং কামনা করি তাঁর বিদেহী আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।