Recent Post

শান্তিনিকেতনের দিনলিপি: শ্রীবাস বিষ্ণু

রাজ্যে করোনার দাপট কম হওয়ায় বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবনে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে পঠনপাঠন শুরু হয়েছে। কলেজের আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা বাইরে থেকে ক্লাস করছে কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্রাবাস বা ছাত্রীনিবাসগুলি এখনও খোলেনি। তাই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমেছে। তাদের দাবি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়সীমা বাড়ানো, অনলাইনে পড়িয়ে অফলাইন পরীক্ষা নেওয়া যাবে না, আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবিলম্বে হোস্টেল খুলতে হবে। বাইরে থাকার কারণে তাদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ হচ্ছে।  বিদ্যালয় স্তরে পাঠভবন শিক্ষাসত্রে অষ্টমশ্রেণি থেকে ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রায় দু’বছর পর বিশ্বভারতী খোলায় শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সর্বত্র খুশির ছোঁয়া। আশা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পঞ্চমশ্রেণি থেকে ক্লাস শুরু হবে। ওদিকে শনিবারের হাট খোলায় শান্তিনিকেতনে দর্শক সমাগম বেড়েছে। এ বছর শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ।  শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের বেশ কয়েক বছর পর ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রায়পুরের জমিদার কর্ণেল নরেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের কাছ থেকে সুরুলের কুঠিবাড়িটি ক্রয় করেন,  উদ্দেশ্য গ্রামোন্নয়ন, গ্রামের মানুষের হিত সাধন। সপরিবারে শিলাইদহে বসবাস কালে জমিদারির কাজ দেখাশোনার সময় গ্রামের মানুষের দুঃখ দুর্দশা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মানুষের নানাবিধ সামাজিক সমস্যা আর্থিক কষ্ট দূর করতে এবং আর্থসামাজিক উন্নতি কল্পে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধীজির মতো তারও বিশ্বাস গ্রামের উন্নতি না হলে  দেশের উন্নতি হবে না। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর কবিমনে ভাবনা শ্রীনিকেতনের কুঠিবাড়িটিকে কেন্দ্রকরে তার আশপাশ গ্রামের উন্নতি সাধন। কিছু পূর্বেই শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বভারতী যা সমগ্র  বিশ্বের কাছে বহুজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র, তার সঙ্গে তিনি গ্রামোদ্যোগের ভাবনায় শ্রীনিকেতনকে যুক্ত করে দিলেন। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের সামগ্রিক রূপ হলো বিশ্বভারতী। 

সে সময় বীরভূম ছিল একটি  বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে প্রচুর রেশম ও তুলা উৎপন্ন হতো। সূতো, কাপড় তৈরি হত, লোহা প্রস্তুত হত। আখের চাষ থেকে গুড় চিটে-গুড় প্রস্তুত ও রপ্তানি হত। এ সব কাজের জন্য ছিল লোহার, নোয়ার যারা উপজাতির অন্তর্গত বাগদি নামে পরিচিত আর ছিল কয়েকশ ঘর তাঁতি। ইংরেজরা দালালদের কাছ থেকে সে সব মাল সওদা করতেন। দাললরা মুনাফার লোভে নিকৃষ্ট মাল সরবরাহ করত। তখন কোম্পানী কিছু ইংরেজকে দেখভালের জন্য এই কার্যে নিযুক্ত করেন। সুরুল অঞ্চলে দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত হন জন চীপ নামে এক ইংরেজ। তিনি এখানে প্রায় আড়াইশো বিঘা জমির বন্দোবস্ত করে বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাসস্থান ছিল সুরুলে নিজের তৈরি  কুঠিবাড়িতে, বর্তমানে বিশ্বভারতীর পল্লীসংগঠন বিভাগ। পরে কুঠিবাড়ির অনতি দূরে নীলের কারখানা তৈরি করে নীলচাষ ও ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে জায়গাটা চীপকুঠি নামে খ্যাত। মি. জন চীপ ১৭৮২ অব্দে ষোলো বছর বয়সে বাংলাদেশে কোম্পানীর কাজ নিয়ে আসেন। ১৮২৮ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেলো তাঁর সম্পর্তির মূল্যের চেয়ে দেনা অনেক বেশি। তখন সুরুলের কুঠিবাড়ি রায়পুরের জমিদার লর্ড সিংহরা কিনে নেন। ইংল্যান্ডে গ্রামোন্নয়নের কথা শুনে কর্নেল নরেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ স্বল্প দামে রবীন্দ্রনাথকে বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন। যদিও ওই বাড়ি ক্রয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে লর্ড নরেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের কাছে আরও অনুরোধ এসেছিল।

সে সময়  ইংল্যান্ডে বসবাস কালে এক ইংরেজ যুবকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়। তাঁর নাম লেনার্ড এল্‌ম্‌হার্স্ট। পূর্বে তিনি ভারতবর্ষ ঘুরে গিয়েছেন এবং এখানকার কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তাঁর মনে সংকল্প ভারতবর্ষের গ্রামে এসে কৃষকদের উন্নতিতে তিনি কাজ করবেন। সেটাই হবে তাঁর জীবনের ব্রত। তখন তিনি আমেরিকায় কর্ণেল ইউনিভার্সিটিতে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পাঠরত। তাঁর এই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শ্রীনিকেতনের কাজে যোগ দিতে আহ্বান জানান। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করে রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন কুঠিবাড়ী সংস্কার করে বাসস্থানের সঙ্গে একটি কৃষি ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যায় শিক্ষা লাভ করে ফিরেছেন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা পুত্র রথীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে শ্রীনিকেতনে একটি কৃষি গবেষণাগার গড়ে উঠুক। আশেপাশের চাষিরা এখান থেকে উন্নত চাষের খবর পাবে, একই সঙ্গে পরীক্ষাগারে ক্ষেতের জমির মাটি এবং চাষবাষের উপযোগী বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা করতে পারবে।   এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে নিয়ে কুঠিবাড়িতে হলো গৃহপ্রবেশ। কিছুদিনের মধ্যেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় কুঠিবাড়িতে তাঁদের বাস স্থায়ী হল না। সে আজ থেকে একশ বছর আগেকার কথা। তখন সুরুল ছিল ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল। তার চারপাশের গ্রামগুলিতে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, অনুন্নত। এলম্‌হার্স্টের আগমনে প্রতিষ্ঠা হলো কৃষিবিদ্যালয়( School of Agriculture) রবীন্দ্রনাথ তার ডিরেক্টর। এলম্‌হাস্টের উদ্যোগে শুরু হলো গ্রামে বন-জঙ্গল পরিস্কার মাটি খুঁড়ে ড্রেন তৈরি, মুরগি, ছাগল পালন, গৃহনির্মাণ, উন্নতভাবে গোপালন, ডেয়ারি, স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি নানাবিধ কাজ। পরে শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। প্রতি বছর এই দিনটিতে পালিত হয় শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিক উৎসব। এই উপলক্ষ্যে বসে তিনদিনের মেলা—‘মাঘমেলা’। 

এ বছর শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা বার্ষিক উৎসব দিনটি মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়েছে। প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত বর্ষিয়ান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শ্রী সুনীতি কুমার পাঠক। করোনার কারণে আগের দিন সন্ধ্যায় বৈতালিক হয়নি এবং মাঘমেলা বসেনি। বর্তমানে বিশ্বভারতীর অধীনে বেশ কিছু গ্রাম নিয়ে এক বিরাট কর্ম যজ্ঞ। বিশ্বভারতীর পল্লীসংগঠন বিভাগের উদ্যোগে গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে মহিলাসমিতি, লাইব্রেরি, সংগীত শিক্ষার ক্লাস, গো-পালন, ডেয়ারী, কৃষিকার্য, চাষের জমির মাটি পরীক্ষা, মৎসচাষ এমন বহুবিধ কাজের সঙ্গে  বিশ্বভারতীর পল্লীসংগঠন বিভাগ  সক্রীয়ভাবে যুক্ত।

সুর সাম্রাজ্ঞী লতা মুঙ্গেশকরের পরলোক গমনের খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছুলে আশ্রমের সর্বত্র বিষাদের ছায়া নেমে আসে।  বিগত ৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকালে শান্তিনিকেতন মন্দিরে এক বিশেষ উপাসনার আয়োজন করা হয়। আচার্যের ভূমিকায় ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য  বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, গানে সংগীতভবন। ১৯৯৭ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশীকোত্তম উপাধি প্রদান করে সম্মান জানিয়েছিল। সে সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক দিলীপকুমার সিংহ। উক্ত সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত অগণিত দর্শকের অনুরোধ ছিল লতাজির কন্ঠে বহুল প্রচলিত তাঁর জনপ্রিয় একটি হিন্দি গান শোনা। সে দিন লতা মুঙ্গেশকর বলেছিলেন, তিনি রবিতীর্থে এসেছেন।  শান্তিনিকেতন তাঁর কাছে মন্দির। এখানে তিনি ঐ সব গান গাইতে পারবেন না। তার বদলে সেদিন সংস্কৃতে একটি স্তোত্র গেয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের তৃপ্ত করেছিলেন। সে স্মৃতি সবার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে।  

সবে ফাল্গুন মাস পড়েছে। ধীরে ধীরে শীত বিদায় নিচ্ছে। শান্তিনিকেতনে শালবীথি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথির বিভিন্ন গাছগুলি থেকে পাতা ঝরা শুরু হয়েছে। ‘ফাগুনের শুরু হতে শুকনো পাতা ঝরলো যত’। চলবে বেশ কিছুদিন। এখন ঋতুরাজ বসন্তের আগমন বার্তা আশ্রমের আকাশে বাতাসে। দখিন-হাওয়ার পরশে গাছের কচি পাতায় খুশির কাঁপন। প্রস্ফুটিত মুকুলের সৌরভে গাছে গাছে মধুকরের গুঞ্জন। পথের ধারে গগণচুম্বি রুদ্রপলাশ গাছগুলিতে সদ্য ফোটা রুদ্রপলাশ ঋতুরাজ বসন্তের আগামন বার্তার ধ্বজা উড়িয়ে সে কথাই বলতে চাইছে। শিমুল গাছে শিমুলের কুঁড়িগুলি এখনো ফোটেনি। শিমুলের ফোটা ফুলে বরণের ডালি সাজিয়ে তারাও রিক্ত হবার আশায় পথ চেয়ে বসে। পলাশ গাছে দু-একটি পলাশ চোখমেলে তাকিয়েছে। বসন্তপূর্ণিমায় তাদেরও ডালে ডালে বসন্ত উৎসবের আয়োজন। এসব দেখে আনন্দে কবি গান ধরেছেন, ‘কে রঙ লাগালো বনে বনে’। করোনা আবহে  শান্তিনিকেতনে বসন্ত-উৎসব পালনের সংবাদ এখনও পাওয়া  যায়নি। হয়তো বিশ্বভারতী নিজেদের মতো করে উৎসবের আয়োজন করবে। সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ থাকবে না। শান্তিনিকেতনের শালবীথি, গৌরপ্রাঙ্গণ আশ্রমের অন্যান্য স্থানগুলি অধীর আগ্রহে বসন্ত উৎসবের অপেক্ষায়,  যদি এবার শান্তিনিকেতনে উৎসবের আয়োজন হয় তাহলে কালো-ধলোর সঙ্গে তারাও আবীরে রাঙা হবে।  
(শ্রীবাস বিষ্ণু, শান্তিনিকেতন, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)

Author

  • শ্রীবাস বিষ্ণু

    শ্রীবাস বিষ্ণু শান্তিনিকেতনের খবরাখবর নিয়ে কলম ধরেছেন। 'শান্তিনিকেতনের দিনলিপি' নামে এই খবর ধারাবাহিক ভাবে নবতরু ই-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

    গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

      আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

        মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন