শান্তিনিকেতনের দিনলিপি: শ্রীবাস বিষ্ণু
নূতন বছরে নবতরুর পাঠকদের প্রতি রইল আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। যদিও নূতন বছরের শুরুতেই করোনা এবং তার নূতন সঙ্গী ওমিক্রন আমাদের জীবনকে আবার স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। ইতিহাস বলছে ইতিপূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহামারি রূপে কোনো কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে তাতে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে কিন্তু কোনো মহামারি পৃথিবী থেকে মানবসভ্যতাকে মুছে ফেলতে পারেনি। নূতন বছরে আমাদের শপথ হোক— আমরা প্রাণ দিয়েই প্রাণকে রক্ষা করব, ভয় পেলে চলবে না । গুজব বা নানা ধরণের প্রচারে কান না দিয়ে, আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজনীয় সাবধানতাটুকু মেনে চলাই বাঁচার একমাত্র উপায়। সবাই সুস্থ থাকুন আনন্দে থাকুন কামনা করি।
শান্তিনিকেতনের দিনলিপি লিখতে বসে মনে হচ্ছে কী লিখি? শান্তিনিকেতনের কী খবর আপনাদের কাছে পরিবেশন করি। কোথায় সেই আনন্দ সংবাদ? বিগত প্রায় দু’বছর ধরে আনন্দবিহীন প্রাণহীন শান্তিনিকেতনের ছবি। রবীন্দ্র শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ, তার প্রাঙ্গণ থেকে প্রাণের স্পর্শ উধাও, নিয়ম রক্ষার তাগিদে কিছু ক্লাস অনলাইনে চলছে। অপরদিকে কেবল ঐতিহ্য রক্ষা করার তাগিদে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে কিছু উৎসব, অনুষ্ঠান, উপাসনার আয়োজন চোখে পড়ে। সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ । এই প্রতিকূলতার মধ্যেও রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস, গাছপালা, এখানকার পবিত্র ধূলার স্পর্শ নিতে দর্শনার্থী আসছেন কিছুটা মনের শান্তি, কিছুটা আনন্দ পেতে তাঁদের বিফল মনোরথে ফিরে যেতে হচ্ছে। এ এক বেদনার ছবি। কবির গানে শুনি, “উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব/ নবজীবনের আশ্বাসে।”
আশা এই অমানিশা কেটে যাবে, অচিরেই আমরা আমাদের জীবনে পথ চলার আনন্দ, ছন্দ ফিরে পাব।
জানুয়ারি মাসে শান্তিনিকেতনে দু’টি অনুষ্ঠান মাঘোৎসব আর মহর্ষি-স্মরণ। এ-বছর মাঘোৎসব দিনটি জানুয়ারি মাসের পঁচিশ তারিখ পড়েছে। ১৭৫১শকের ১১মাঘ (১২৩৬বঙ্গাব্দ) শনিবার ব্রাহ্মসমাজের নবগৃহে প্রবেশের পুণ্যদিনটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে মহর্ষিদেব জোড়াসাঁকো ভবনে ১১ মাঘের উৎসব প্রবর্তন করেন, দিনটি মাঘোৎসব নামে চিহ্নিত। পরে ১১ মাঘ দিনটিও শান্তিনিকেতনে ‘মাঘোৎসব’ রূপে পালিত হয়ে আসছে। শান্তিনিকেতনে অনেকেই বলেন ‘সাজেরমন্দির’। শান্তিনিকেতন মন্দিরে উপাসনায় সাদা পোশাকে আসা রীতি কিন্তু এ দিনটিতে কেউ সাদা পোশাকে এলেও অনেকেই বিশেষত যাঁরা ব্রাহ্ম তাঁরা ভিন্ন পোশাকে সেজেগুজে উপাসনায় আসেন। কারণ এটি ব্রাহ্মদের সাংবৎসরিক উৎসব। এই উপলক্ষ্যে সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতন উপাসনা গৃহ ও তার প্রাঙ্গণ আলোকসজ্জার উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয়ে ওঠে। ১১ মাঘ ১৩১৫ রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন মন্দিরে আচার্যের ভাষণে মাঘোৎসবকে ‘নবযুগের উৎসব’ আখ্যা দিয়ে দিনটির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “আমরা আজ পঞ্চাশ বৎসরের ঊর্ধ্বকাল এই ১১ই মাঘের উৎসব করে আসছি। আমরা কী করছি, এ উৎসব কীসের উৎসব, সে কথা আমাদের বোঝবার সময় হয়েছে; আর বিলম্ব করা চলবে না। আমরা মনে করেছিলুম আমাদের এই উৎসব ব্রাহ্মসমাজের উৎসব। ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের সম্বৎসরের ক্লান্তি ও অবসাদকে উৎসবের আনন্দে বিসর্জন দেবেন, তাঁদের ক্ষয়গ্রস্ত জীবনের ক্ষতিপূরণ করবেন, প্রতিদিনের সঞ্চিত মনিলতা ধৌত করে নেবেন, মহোৎসবক্ষেত্রে চিরনবীনতার যে অমৃত-উৎস আছে তারই জল পান করবেন এবং তাতেই স্নান করে নবজীবনে সদ্যোজাত শিশুর মতো প্রফুল্ল হয়ে উঠবেন। এই লাভ এই আনন্দ ব্রাহ্মসমাজ উৎসবের থেকে গ্রহণ যদি করতে পারেন তবে ব্রাহ্মসম্প্রদায় ধন্য হবেন, কিন্তু এইটুকুতেই উৎসবের শেষ পরিচয় আমরা লাভ করতে পারিনে। আমাদের এই উৎসব ব্রাহ্মসমাজের চেয়ে অনেক বড়ো; এমনকী, একে যদি ভারতবর্ষের উৎসব বলি তাহলেও একে ছোটো করা হবে। আমি বলছি এ উৎসব মানবসমাজের উৎসব। ……আমাদের উৎসবকে ব্রহ্মোৎসব বলব কিন্তু ব্রাহ্মউৎসব বলব না এই সংকল্প মনে নিয়ে আমি এসেছি; যিনি সত্যম্ তাঁর আলোকে এই উৎসবকে সমস্ত পৃথিবীতে আজ প্রসারিত করে দেখব; আমাদের এই প্রাঙ্গণ আজ পৃথিবীর মহাপ্রাঙ্গণ—এর ক্ষুদ্রতা নেই।” —মাঘোৎসবের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে বিশ্বমানবের মিলনের বার্তা।

২০ জানুয়ারি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে সকালে শান্তিনিকেতন উপাসনাগৃহে গভীর শ্রদ্ধায় পালিত হয় উপাসনা বিকেলে ছাতিমতলায় বসে স্মরণসভা। দিনটি শান্তিনিকেতনের আশ্রম জীবনে ‘মহর্ষি-স্মরণ’ হিসাবে চিহ্নিত। বীরভূমের এই রুক্ষ ডাঙায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা না করলে কেই বা আজ শতবর্ষ প্রাচীন শান্তিনিকেতন আশ্রমের রূপটি দেখতে পেতেন? নিজেকে প্রকাশ করার এমন সুন্দর রমণীয় স্থানটিকে আশ্রমের রূপ ও বিকাশের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথই বা কোথায় পেতেন? কোন্ ঐশ্বরিক মন্ত্রবলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের যে দীপ শিখাটি জ্বালিয়েছিলেন আজ তা সর্বমানবের কাছে রবিতীর্থ রূপে বিরাজমান। মর্তলোকে শান্তিনিকেতন মহর্ষির দান। শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত এক মহর্ষি স্মরণে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “৭ই পৌষে তিনি যে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ৬ই মাঘ মৃত্যুর দিনে সেই দীক্ষাকে সম্পূর্ণ করে তাঁর মহৎ জীবনের ব্রত উদ্যাপন করে গেছেন। শিখা থেকে শিখা জ্বালাতে হয়। তাঁর সেই পরিপূর্ণ জীবন থেকে আমাদেরও অগ্নি গ্রহণ করেতে হবে। এইজন্য ৭ই পৌষে যদি তাঁর দীক্ষা হয়, ৬ই মাঘ আমাদের দীক্ষার দিন। তাঁর জীবনের সমাপ্তি আমাদের জীবনকে শিক্ষা দান করে—জীবনের দীক্ষা।”
সে সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে এক উজ্জ্বল নাম, যার ভিত্তি রচনা করেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। অর্থ, সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। যৌবনে সুখ-ভোগে গা ভাসিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথও। পিতামহীর মৃত্যু দেবেন্দ্রনাথের জীবনে আধ্যাত্মিক চেতনায় এক নূতন পথের দিশারী। পিতামহী অলকাসুন্দরীর মৃত্যুর পূর্বে শ্মশানে বসে তাঁর মনে হল তিনি যেন আর পূর্বের মানুষ নন। ঐশ্বর্যের উপর বিরাগ জন্মাল, গালিচা দুলিচা সকল হেয় বোধ হল, মনের মধ্যে ক্ষণিক অভুতপূর্ব আনন্দ অনুভব করলেন। পরমুহূর্তেই এক উদাসভাব, বিষাদে মন ভারাক্রান্ত। ফলস্বরূপ ঈশ্বর চিন্তায় তাঁর অতৃপ্ত মনকে কে যেন উতলা করে দিয়ে গেল। ভোগ ঐশ্বর্যে বিরাগ জন্মাল মনে হল জীবন নীরস, পৃথিবী শ্মশানতুল্য। কিছুতেই সুখ নাই কিছুতেই শান্তি নাই। সে সময় তার মুখ দিয়ে একটি গান বের হলো, …’হবে, কি হবে দিবা আলোকে, জ্ঞান বিনা সব অন্ধকার’। এটাই তাঁর প্রথম গান। তখন তাঁর ইশ্বর সাধনা পৌত্তলিকতার অন্ধ বিশ্বাসে নয় জ্ঞানের আলোকে। মনের এইরূপ অশান্ত সময়ে একদিন সংস্কৃত বইয়ের একটি ছেঁড়া পাতা উড়ে যাচ্ছে দেখে ঔৎসুক্যবশত তাঁকে ধরলেন। তাতে লেখা ঈশোনিপোষদের একটি শ্লোক। ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্ব্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ / তেন ত্যক্তন ভুঞ্জিথা মাগৃধঃ কস্যসিদ্ধনং।’ যখন এর অর্থ জানলেন, ‘জগতে যাহা-কিছু সমস্তই ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া দেখিবে, তিনি যাহা দিতেছেন, তাহাই ভোগ করিবে, কাহারো ধনে লোভ করিবে না।’ মন্ত্রের অর্থ জানার পর তাঁর মনে হলো স্বর্গ থেকে অমৃত এসে তাঁকে অভিষিক্ত করলো। অশান্ত মন কিছুটা তৃপ্ত হল।
২১শে ডিসেম্বর ১৮৪৩, বাংলা ৭ই পৌষ রামমোহনের যোগ্য উত্তরসাধক দেবেন্দ্রনাথ রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। বাংলার সমাজ জীবনে এ ঘটনা যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি ব্রাহ্মসমাজের ক্ষেত্রেও নবজীবন লাভ। এ ছাড়াও তত্ত্বরঞ্জিনী সভা, তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা,তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ, ব্রাহ্মসমাজ বাড়িতে পৌত্তোলিকতার পরিবর্তে উপাসনা, নববর্ষ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের প্রচলন, ভ্রমণ, এ রকম বহুবিধ সামাজিক ও আধ্যাত্মিক কাজে তাঁর জীবন ছিল সম্পৃক্ত। তত্ত্ববোধিনী সভার প্রথম সাংবৎসরিক উৎসবে দেবেন্দ্রনাথ একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই সভায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপস্থিত ছিলেন। সে দিনের সভায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ।” উক্তিটি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মনে দাগ কেটেছিল। দশবছর পর তিনি যখন ‘বোধোদয়’ নামক একটি পুস্তক লেখেন তখন মহর্ষির এই উক্তিটি পুস্তকে স্থান পেয়েছিল।
মহর্ষির সুদীর্ঘ জীবন নানা বৈচিত্রে, অসাধারণত্বে পরিপূর্ণ, বোধিবৃক্ষেরন্যায় তাঁর অফুরাণ জ্ঞানভাণ্ডার, যিনি ছিলেন জীবন্ত উপনিষদ, বেদজ্ঞ, জীবনের নানা সুখ-দুঃখে, সম্পদে-বিপদে, মানে-অপমানে যাঁর লক্ষ্য ছিল স্থির, কর্তব্য পালনে অবিচল। বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে যিনি রামমোহনের পর দ্বিতীয় সৃজনীশক্তি, সমাজসংস্কারক, বহুগুণের অধিকারী, এ রকম একজন মহামানবের জীবনের ইতিবৃত্ত কয়েকটি কথায় বলা দুরূহ কাজ। পরবর্তীতে দেখি শান্তিনিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে তিনি তাঁর দীক্ষার দিন ৭ই পৌষকে পবিত্র দিন হিসাবে আশ্রম জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। ৬ই মাঘ ১৩১৬ জোড়াসাঁকোয় মহর্ষিভবনে মহর্ষির মৃত্যুর পঞ্চম বার্ষিকী শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গীত হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত ‘কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরার আস–/ সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো, ধরায় আস।’ গীতাঞ্জলির একান্ন সংখ্যক গানটি ওই বছর পৌষ মাসে লিখিত। প্রতিবছর মহর্ষি স্মরণে ছাতিমতলার আকাশে বাতাসে এই গানের কথা ও সুর মহান সাধকের বিশাল কর্মজীবনকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করিয়ে দেয়।