শান্তিনিকেতনের দিনলিপি: শ্রীবাস বিষ্ণু
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই হালকা শীতের আমেজ। তার আভাস উত্তুরে হিমেল হাওয়ায়, আমলকীর কাঁপন লাগা পাতায়, শিশির সিক্ত ঘাসে অথবা সকালের মিষ্টি রোদে। শারদীয় অবকাশের পর প্রকৃতির এই পট পরিবর্তন শান্তিনিকেতনে ৭ পৌষ সাংবৎসরিক উৎসবের হাতছানি। এ মাসের ১২ তারিখ থেকে যে অকাল বর্ষণ শুরু হয়েছে তাতে জনজীবন বিপর্যস্ত, ফসলের ক্ষতি। রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে। ক্যানেল পাড়ে সোনাঝুরি প্রাঙ্গণে শনিবারের হাট বসেনি, বৃষ্টিভেজা শান্তিনিকেতন। প্রকৃতির এই খামখেয়ালি স্বভাবের মধ্যে বুঝতে পারছি মেঘ কেটে গেলে এবার শীতের প্রভাব বাড়বে।
“এলো যে শীতের বেলা বরষ পরে। এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে।”
গ্রাম বাংলায় ফসল কাটার সময়। শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসব, পৌষমেলা, কুয়াশা ঘেরা সকাল, গোয়ালপাড়ায় যাবার পথে টাটকা খেজুর রসের আকর্ষণ, মিঠে রোদে কোপাইয়ের পাড়ে বনভোজন, গ্রাম বাংলায় ঘরে ঘরে নবান্নের প্রস্তুতি—অগ্রহায়ণ-পৌষ মানেই সর্বত্র এক খুশির উৎসব

সম্প্রতি বিশ্বভারতীতে পঠন-পাঠন শুরু হবার ইঙ্গিত মিলেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যালয়স্তরের উঁচু শ্রেণির পঠনপাঠন আরম্ভ হতে পারে। হোস্টেলগুলির মেরামতির কাজ চলছে। এর মধ্যে বিশ্বভারতীর উৎকর্ষ মুল্যায়নে শীঘ্রই NAAC (National Assessment and Accreditation council)-র এক প্রতিনিধি দল শান্তিনিকেতনে আসবার কথা। তার প্রস্তুতিতে বিশ্বভারতীতে এখন সাজো সাজো রব। ইতিমধ্যে পৌষমেলা করা নিয়ে বিশ্বভারতীর কাছে আবেদন নিবেদন চলছে কিন্তু পৌষমেলা নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
বীরভূমের সম্ভ্রান্ত জমিদার রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে কুড়িবিঘা জমি কেনার পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন আশ্রম রক্ষার্থে একটি ট্রাস্ট-ডীড সম্পন্ন করেছিলেন। সেখানে তিনি একটি মেলার কথা বলেছেন। তখন তো এই উদার উন্মুক্ত জনমানবহীন রাঢ় অঞ্চলের আশ্রমটি ছিল একটি মরূদ্যানের মতো। তার চারপাশ ঘিরে ধূ-ধূ ডাঙা, দূরে দূরে গ্রাম, ফলে আশপাশ অঞ্চলের মানুষজনের সঙ্গে আশ্রমের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। পাশে গ্রাম বলতে ভুবনডাঙা, সেখানে কয়েক ঘর মানুষের বাস। হয়তো শান্তিনিকেতনের আশপাশের গ্রাম ও তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে মহর্ষি তাঁর ট্রাস্ট-ডীডে একটি গ্রাম্যমেলার পরিকল্পনা করেছিলেন; যেখানে একাধারে জাতিধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষে মানুষে মিলন হবে, তেমনি গ্রামের মানুষজন তাদের হাতে তৈরি কুটির শিল্পের নিত্য প্রয়োজনীয় নানা কাজের পসরা নিয়ে মেলায় বসবে।
৭ পৌষ, ২১ ডিসেম্বর ১৮৯১ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ওই দিন পৌষ উৎসবের সূচনা হয়। স্থানীয় মানুষজনের অনেকের কাছে এই ব্রহ্মমন্দিরটি কাচমন্দির হিসাবে পরিচিত। পৌষ উৎবের সূচনায় মেলা বসেনি। মন্দির সংলগ্ন মাঠে প্রথম মেলা বসে ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার চতুর্থ বৎসরে ১৮৯৪ সালের ৭ পৌষ। আজ সেই গ্রাম্য মেলার উদ্দেশ্য কেউ মনে রাখেননি। রবীন্দ্র-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী হয়েছে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বর্তমানে মেলার পরিসর বেড়ে হয়েছে এক বিশাল বাণিজ্যিক মেলা। এখন ৭ পৌষের উৎসবের চেয়ে মানুষের কাছে বড়ো আকর্ষণ শান্তিনিকেতন পৌষমেলা। লক্ষ লক্ষ মানুষের আনাগোনা। রাস্তাঘাট বন্ধ, যাতায়াতে নানান বিধি নিষেধ— স্থানীয় মানুষজনের জনজীবনে নাভিশ্বাস।
সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চারিদিকে রমরমা ব্যবসা। যানবাহন থেকে মেলার দোকানপাটে সব রকমের জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। মেলার কয়েকমাস আগে থেকেই বোলপুরের হোটেলগুলিতে থাকার জায়গা চড়াদামে অগ্রিম বিলি হয়ে যায়। আদিকালে বহু ভক্তবৃন্দ পৌষ উৎসব উপলক্ষে এখানকার অতিথি হয়ে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন আসতেন। পঞ্চাশের দশকেও মেলায় আগত দর্শনার্থীরা বিশ্বভারতীর ব্যাবস্থাপনায় এখানে থাকার জায়গা পেতেন। সিংহসদন, প্রাককুটির, পাঠভবন ছাত্রাবাস সংগীতভবন প্রভৃতি জায়গায় হলঘরগুলির মেঝে খড় দিয়ে ঢেকে তার উপর শতরঞ্চি বিছিয়ে থাকার ব্যবস্থা হতো। মাটির জালা বা কলসিতে থাকত খাবার জল। সংলগ্ন বাথরুমগুলিতে স্নানের ব্যবস্থা। তাঁরা সকলেই শ্রদ্ধায় ৭ই পৌষের সকালে উপাসনায় যোগ দিতেন। এ সব দেখভালের জন্য অধ্যাপক, কর্মী ও ছাত্রদের নিয়ে গেস্ট-অ্যাকোমোডেশন কমিটি সবসময় সজাগ থাকতেন। সে দিন আর নেই, নেই তার কোনো ব্যবস্থা। মেলা চলাকালীন বহু দূর থেকেই যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সারি সারি মানুষ দলবেঁধে হেঁটে মেলাপ্রাঙ্গণে আসেন। এতসব হয়রানির মধ্যেও কাতারে কাতারে মানুষ পৌষমেলায় আসেন আনন্দ খুঁজতে। কালোর দোকান আর বসেনা, সেঁজুতি ঘিরে প্রাক্তনীদের পুনর্মিলন, প্রদর্শনী, ইলেকট্রিক ট্রেন, নাগরদোলা, সার্কাস, রকমারি দোকান, খাবার রেস্টুরেন্টগুলি ঘিরে হইচই খাওয়া আর আড্ডা। বিনোদন মঞ্চে বাউলগান, কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, রাইবেশে থেকে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক দলের নানা অনুষ্ঠান। বর্তমান পৌষমেলা থেকে গ্রাম্যমেলার ছবিটি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে গ্রামের মানুষের হাতে তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে বসা। তা যদিও বা কিছু থাকে তার ঠাঁই মেলাপ্রাঙ্গণের বাইরে। আমরা বলি বর্তমান কালে পৌষমেলা তার রূপ পালটেছে, গোরুর গাড়ি নেই, নেই কাঠের নাগরদোলা কিন্তু তারমধ্যে যেটি সদর্থক, এই মেলাকে কেন্দ্র করে এখনও গ্রাম শহরের মানুষের মিলনের ছবিটি অমলিন।
পৌষ উৎসবের সূচনায় শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের’ প্রতিষ্ঠা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ পাঁচ জন ছাত্র ও গুটিকয়েক মাস্টারমশাইকে নিয়ে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০১ সালে ৭ পৌষের দিনে। ৭ পৌষ, পিতার দীক্ষার দিনটিকে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবছর গুরুত্ব সহকারে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে বলেছেন, “এই সেই ৭ পৌষ শান্তিনিকেতন আশ্রমকে সৃষ্টি করেছে এবং প্রতিদিন একে সৃষ্টি করে তুল্চে।”
তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শের মধ্যে ৭ পৌষের মেলাটিকে তিনি বিশেষ স্থান দিয়েছিলেন। সে সময় পৌষ উৎসবের সঙ্গে পৌষমেলায় ছাত্র-ছাত্রীদের নানা দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হত। বিশ্বভারতী পর্বেও পৌষমেলা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অঙ্গ ছিল আজও তাই আছে কিন্তু পৌষমেলা লাগামবিহীনভাবে বাণিজ্যিক আকার ধারণ করায় এবং শহুরে মেলায় পর্যবসিত হওয়ায় সেই বাঁধন আজ অনেকটাই শিথিল। মেলার আকার যদি ছোটো করা না যায় তাহলে আজকের দিনে সমস্ত কিছু খেয়াল রেখে এত বড়ো মেলার আয়োজন করা, তাকে কেন্দ্র করে জনসমাগম, নিরাপত্তা, দূষণ সব কিছুর দায়ভার নেওয়া বিশ্বভারতীর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কতটা সম্ভব— স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন এসে যায়। কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ রকম বিশাল বাণিজ্যিক মেলার আয়োজন করছেন বলে জানা নেই।
শান্তিনিকেতনের জীবনে নভেম্বর মাস বিশেষভাবে স্মরণীয় কারণ রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর জন্মমাস। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের জন্ম ১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাসের ২৭ তারিখ। সংক্ষেপে বলি—ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে রথীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন। এন্ট্রান্স পরীক্ষার পূর্বে তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়। কৃষিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে বেশ কিছু সময় শিলাইদহে জমিদারির কাজ এবং চাষবাস নিয়ে গবেষণামূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন। পিতার শোক-দুঃখে তিনি ছিলেন নিত্য সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথের কবি জীবনের সার্থক রূপায়ণে প্রচার বিমুখ রথীন্দ্রনাথের নিরলস অবদান সর্বজনবিদিত। শান্তিনিকেতনের বাড়িঘর, পরিবেশের সৌন্দর্যায়ন থেকে নানা পরিকল্পনায় তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। তাঁর হাতে কাঠের কাজ, বাঁশের কাজ আজও সৃস্ষ্টিশীল শিল্পচর্চার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তিনি বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য। তাঁর লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’ বইটি পিতাপুত্রের সান্নিধ্যের কথা, পরিবারে দুঃখের আঘাতের কথা, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ থেকে আশ্রমজীবনের মনোগ্রাহী বর্ণনার এক সুন্দর চিত্রায়ণ। কয়েক দশক ধরে রথীন্দ্রনাথের জন্মদিনে বিশ্বভারতীর উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘রথীন্দ্রমেলা’।
পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর জন্ম ১৮৯৪ সালের ৫ নভেম্বর। ইনি গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথের ভাগ্নী শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায় ও বিনয়িনী দেবীর দ্বিতীয় কন্যা, বাল্যবিধবা। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় তাঁর সঙ্গে পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। তাঁর কথায়, “ষোলো বৎসর বয়সে বিয়ে হয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম, আনাড়ি মেয়ে কিছুই জানিনা। আমার শিক্ষা-দীক্ষা যা-কিছু সব আমার স্বামী ও শ্বশুরের কৃতিত্ব। তাঁরাই আমাকে শিখিয়েছেন, পড়িয়েছেন এবং চালিয়েছেন। প্রতি নিয়তই তাঁদের আমি শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।” শান্তিনিকেতনে তিনি সকলের ‘বৌঠান’ রবীন্দ্রনাথের কাছে স্নেহের ‘মামনি’। দেশে বিদেশে বহু জায়গায় ভ্রমণে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়েছেন। আশ্রম বা আশ্রমের বাইরে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য বা অনুষ্ঠানাদিতে তাঁর ছিল সক্রিয় ভূমিকা। তার আভাস কবির চিঠিতে, “বৌমা, বর্ষামঙ্গলের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত। ……সঙ্গীত বিভাগের এই কাজটা তোমার, দায়িত্ব তোমারই, গান, নাচ এবং যন্ত্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম তোমাকেই করতে হবে…… তোমার অনুপস্থিতেই চন্ডালিকার অনেক কাটাছাঁটা করতে হয়েছে—তোমার মঞ্জুরির অপেক্ষায় রইলুম।”

শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার সময় প্রতিমাদেবী অসুস্থ থাকায় কবির সঙ্গী হতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের অবস্থা গুরুতর খবর পেয়ে পরে কলকাতা গিয়েছিলেন। অসুস্থ কবি জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে পীড়িতা পুত্রবধূকে লিখলেন, “মামনি, তোমাকে নিজের হাতে লিখতে পারিনি বলে কিছুতে লিখতে রুচি হয় না।”
চিঠির শেষে কাঁপা হাতে সই করেছেন ‘বাবামশায়’— জীবনের শেষ স্বাক্ষর। আজ এই দিনিলিপি লিখতে বসে আশ্রমপিতা, পুত্র এবং পুত্রবধূ সকলকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই মাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাজ্ঞলি গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে আন্তর্জাতিক সম্মান ‘নোবেল প্রাইজ’ পেয়েছিলেন। নোবেল প্রাইজ ঘোষণার দিনটি ছিল ১৩ নভেম্বর ১৯১৩। কিন্তু শান্তিনিকেতনে সে খবর পৌঁছেছিল ১৫ নভেম্বর। নোবেলের পুরো নাম আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল। জন্ম ১৮৩৩ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহলমে। ইনি একজন যশস্বী বিজ্ঞানী। রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিশেষ পারদর্শী। ১৮৬৫-৬৬ সালে ডিনামাইট আবিষ্কার করে অতুল সম্পদের অধিকারী হন। ডিনামাইটের বিধ্বংসী রূপ দেখে তিনি তার আবিষ্কারের জন্য এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যার ফল স্বরূপ তিনি মানব কল্যাণে প্রায় বিশ লক্ষ পাউন্ড (ভারতীয় টাকায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা) দান করে যান। যার সুদ থেকে প্রতি বছর জড়বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য ও বিশ্বশান্তির শ্রেষ্ঠ সাধকদের পুরস্কৃত করা হয়। প্রত্যেক পুরস্কারের মুল্য আট হাজার পাউন্ড তখনকার দিনে ভারতীয় মুল্যে এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। ১৮৯৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯০১ সালে থেকে এই পুরস্কারের সূচনা এবং ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য ( SONG OFFERINGS) সাহিত্যে নোবেল পান। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ১২ জন সাহিত্যিক এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। ইউরোপের বাইরে রবীন্দ্রনাথ প্রথম এশিয় যিনি এই মহান সম্মানে ভূষিত হন।
ইন্ডিয়া সোসাইটির উদ্যোগে গীতাঞ্জলি প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ইয়েটস্ তার ভূমিকা লেখেন। প্রথমে বইটি ৭৫০ কপি ছাপা হয়েছিল। ৫০০ কপি সদস্যদের মধ্যে বিতরিত ও ২৫০ কপি সর্বসাধারণের জন্য বিক্রীত হয়। পাঠক, আমাদের ধারণা রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ইংরেজী বা সুইডিশ অনুবাদ পড়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্যরা মোহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেন। যতটা সহজ মনে হয় বিষয়টা ততটা সহজ ছিলনা। সে বছর নোবেল প্রাইজের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ২৮ জনের নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। প্রথমে পুরস্কারের জন্য নোবেল কমিটিতে রবীন্দ্রনাথের নাম অনুমোদিত হয়নি। গীতাঞ্জলি পড়ে যেমন বহু মানুষ মুগ্ধ হয়েছেন তেমনি অনেকে ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন, দূর দেশের কবি, আরও একবছর অপেক্ষা করা যাক। ইংল্যান্ডের Thomas hardy নাম প্রস্তাব করেছিলেন ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি অফ লিটারচারের ৯৭ জন সদস্য। শেষে সুইডিশ অ্যাকাডেমির বিবেচনার্থে নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত যখন পেশ করা হল তখন রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে এগিয়ে এলেন সুইডেনের সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবি Carl Gustaf Verner von Heidenstam যিনি একবছর আগে এই কমিটির সদস্য হয়েছেন। তিন বছর পর তিনিও সাহিত্যে নোবেল পান। সেদিন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তিনি যা লিখেছিলেন এবং নোবেল কমিটির সভাপতি পের হালস্ট্রমের ভারতীয় কবির স্বপক্ষে প্রতিবেদন অ্যাকাডেমির সদস্যদের প্রভাবিত করে। সংখ্যাধিখ্য ভোটে রবীন্দ্রনাথের নাম ওই বছর নোবেল প্রাপক হিসাবে ঘোষিত হয়। স্টকহলম থেকে নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে বৃহস্পতিবার খবরটি ঘোষিত হয়। পরে লন্ডন থেকে খবরটি ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ঠিকানা সুইডিশ অ্যাকাডেমির জানা ছিল না। খোঁজ খবরের পর ১৪ নভেম্বর সরকারিভাবে লন্ডন থেকে যে সংবাদটি কলকাতায় পাঠানো হয় তার অবিকল রূপটি ছিল এই রকম— “XF PH LONDON PO 14 EASTN LN 19 RABINDRANATH TAGORE 6 DN TAGORE/ LANE JORASANKO CALCUTTA .
SWIDISH ACADEMY AWARDED YOU NOBEL PRIZE LITERATURE PLEASE WIRE ACCEPTATION SWIDISH MINISTER .”

ইতিমধ্যে এই আনন্দ সংবাদটি ১৪ নভেম্বর কলকাতার সান্ধ্য-দৈনিক Empire এ প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ একবছর চারমাস বিদেশে কাটিয়ে সবে শান্তিনিকেতনে ফিরেছেন। সেবছর ৯ নভেম্বর শারদোবকাশের পর বিদ্যালয় খুলেছে। ১৫ নভেম্বর তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর গানের কাণ্ডারি ও ভান্ডারী দিনেন্দ্রনাথকে নিয়ে মোটর গাড়িতে চৌপাহাড়ি শালবনে বেড়াতে চলেছেন । জোড়াসাঁকোয় খবর পৌঁছুলে পরদিন জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এক তারবার্তায় খবরটি শান্তিনিকেতনে পাঠান। এদিকে কলকাতায় খবরটি চাউর হতে কবির বহু গুনমুগ্ধ একের পর এক অভিনন্দন বার্তা পাঠাতে থাকেন শান্তিনিকেতনে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের টেলিগ্রামটি প্রথম রবীন্দ্রনাথের হাতে পৌঁছুলে কবি সেটিকে নিয়ে না দেখে রেখে দেন। কিন্তু ভ্রমণসঙ্গীদের কৌতূহল নিবারণ করতে সেটি খুলে দেখতে হয়, তখন জানতে পারলেন তিনি নোবেল প্রাইজ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এত বড়ো আনন্দ সংবাদ মুহূর্তে সারা আশ্রম রাষ্ট্র হয়ে যায়। রান্নাঘরে শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী আনন্দে আত্মহারা হয়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। “প্রকৃতি বিজ্ঞানী শিক্ষক জগদানন্দবাবু ঘোষণা করলেন চারদিন বিদ্যালয় বন্ধ। আশ্রমের নিদারুণ অর্থাভাবের মধ্যে মা লক্ষী যেন মুখ তুলে তাকিয়েছেন। ২৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আম্রকুঞ্জে বসল সংবর্ধনা সভা। বিশেষ ট্রেনে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন এলেন কবির বহু গুণগ্রাহী, সকলেই আম্রকুঞ্জের সভায় জড়ো হয়েছেন, বন্ধুবর জগদীশ্চন্দ্র বসু সভাপতি।
পরবর্তীতে আর এক জনের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে সমগ্র আশ্রম জুড়ে খুশির হাওয়া বয়েছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় পাঠভবনের প্রাক্তন ছাত্র অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। কয়েক পুরুষ ধরে তাঁরা শান্তিনিকেতনবাসী। আদিযুগে তাঁর মা ছিলেন ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের ছাত্রী। রবীন্দ্র স্নেহধন্যা। তখনও বিদ্যালয়ের পাঠভবন নামকরণ হয়নি। দাদু আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন রবীন্দ্র পরিকরে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেদিনও এই আনন্দ সংবাদ পাবার পর বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা হয়েছিল। পাঠভবন আশ্রমসম্মিলনীর পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মী সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করার পর নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের মাস্টামশাইদের নিয়ে সভা বসেছিল আম্রকুঞ্জে। সন্ধ্যায় আলোকসজ্জা, সান্ধ্য অনুষ্ঠানে তাঁর মা প্রধান অতিথি, বৈতালিক কত কি! সে কথা অন্য কোনও একসময় বলা যাবে।
(শান্তিনিকেতন, ২০ নভেম্বর ২০২১)
জীবনে একবার শান্তিনিকেতন গেছি।এই গল্পের জন্য শান্তিনিকেতন খুব কাছ থেকে দেখতে পাই।