শান্তিনিকেতনের দিনলিপি: শ্রীবাস বিষ্ণু
দীর্ঘকাল ধরে শান্তিনিকেতনের এমন প্রাণহীন ছবি প্রবীণ আশ্রমিক থেকে স্থানীয় মানুষজন এর আগে কখনও দেখেছেন কি না আমার জানা নেই। করোনার আতঙ্কে এ কোন মূক বধির শান্তিনিকেতন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এখন এ-কথাটা সকলেই হয়ত অনুভব করতে পারছেন। বর্তমানে লকডাউন শিথিল হওয়ায় নিয়ম মেনে অফিসকর্মী, শিক্ষকদের বিভিন্ন ভবনে গতানুগতিক উপস্থিতি চলছে। কিছু কিছু ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে কিন্তু তৎসত্ত্বেও শান্তিনিকেতনের আশ্রম প্রাঙ্গণজুড়ে এক বিষন্নতার ছবি। তার চারপাশ ফাঁকা, মানুষের চলাচল নেই বললেই চলে। কোপাই নদীর ধারে, গ্রামের পথেঘাটে কাশের বনে শরতের হাসিমুখ দেখা গেলেও এ-সময় শান্তিনিকেতনে শিক্ষক দিবস, শারদোৎসব, আনন্দবাজার, শ্রীনিকেতনে শিল্পোৎসব প্রভৃতি অনুষ্ঠান বন্ধ। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন উপলক্ষ্যে শিক্ষকদিবস পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এক বাড়তি আনন্দ। এই দিনটিতে পাঠভবনের অধ্যক্ষ থেকে মাস্টারশাইদের একপ্রকার ছুটি, কিন্ডারগার্টেন থেকে সমগ্র বিদ্যালয় পরিচালনার ভার সর্বোচ্চ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের উপর থাকে। বৃহত্তর শিক্ষাজীবনে প্রবেশের আগে বিদ্যালয় জীবনে শিক্ষকরূপে ক্লাস নেবার এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। ক্লাস বিরতি পর্বে প্রাক্তন বর্তমান শিক্ষকদের চায়ের আসর, পুরনো দিনের ছবির প্রদর্শনী থেকে দুপুরে মাস্টারমশাইদের সঙ্গে ক্যারাম, টেবিলটেনিস, বিকেলে ফুটবল খেলা। সন্ধ্যায় উপরি পাওনা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিনীত নাটক। সবশেষে রাত্রে আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রাক্তন-বর্তমান মাস্টারমশাইদের নৈশাহার। দু’বছর এই অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বহু ছাত্রছাত্রী তাদের বিদ্যালয় জীবনে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হল। বহুপূর্বে শিক্ষক দিবসে বিনয়ভবনের উদ্যোগে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবন ঘুরে দুঃস্থ শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাহায্যকল্পে অর্থ সংগ্রহ করা হত।

প্রতি বছর সতেরো সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শ্রীনিকেতনে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পোৎসব। বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা। মনেকরা হয় তিনি বিশ্বের স্রষ্টা। বিশ্বভারতীতে নানা শিল্পকর্মের পীঠস্থান শ্রীনিকেতন, তাই এই দিনটি ঘিরে সেখানে উৎসবের আয়োজন করা হয়। মহর্ষির শান্তিনিকেতন আশ্রম নিরাকার এক ব্রহ্মের উপাসনার জায়গা। এখানে মূর্তি পুজোর চল নেই। শ্রীনিকেতনও তার মধ্যে, তাই বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষ্যে সেখানে মূর্তির বদলে হয় ‘ঘট’ বন্দনা। শিল্পোৎসবের উদ্বোধন, শিল্প প্রদর্শনী, খেলাধূলা নানা অনুষ্ঠান ঘিরে দিনটি থাকে আনন্দময়। অনেকের ধারণা শ্রীনিকেতনে শিল্পোৎসব রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে চলে আসছে— আসলে তা ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর শিল্পোৎসবের সূচনা হয়। এই উপলক্ষ্যে গান ‘নমো যন্ত্র’ বা “কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে।” যদিও গানগুলি অন্য সময়ে লেখা।
প্রতিবছর শারদ অবকাশের পূর্বে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবনের ছাত্রছাত্রীরা নাটক মঞ্চস্থ করে। এক পক্ষকাল ধরে সন্ধ্যায় বিভিন্ন স্বাদের নাটক পরিবেশিত হয় শান্তিনিকেতনের নাট্যঘরে। মাঝে একদিন শান্তিনিকেতন কর্মীমণ্ডলীর ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয় ‘শারদোৎসব’। পূর্বে প্রাক্তনীরাও এই নাট্যোৎসবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। মহালয়া বা পিতৃতর্পনের দিন শান্তিনিকেতন গৌরপ্রাঙ্গণে বসে আনন্দবাজার। পাঠভবন- শিক্ষাসত্র থেকে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন ভবনের ছাত্রছাত্রীরা মেলায় দোকান দেয়। আর্তের সেবার উদ্দেশ্যে দোকানের লভ্যাংশ জমা পড়ে শান্তিনিকেতন কর্মীমণ্ডলীর সেবাশাখায়। খাবার দোকান থেকে হাতেরকাজ, নাটক, তাৎক্ষণিক কবিতা লেখার কর্ণার কত কী! দোকানের নামেও অভিনবত্ব ‘জগাখিচুড়ি’ ‘আমরা ক’জন’, ‘খাইখাই’, ‘হ-য-ব-র-ল’ ইত্যাদি ইত্যাদি । দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের সময়ে প্রথমদিকে আনন্দবাজার বসেছে বৈশাখ মাসে। তখন ছেলেরাই দোকান দিত। বিদ্যালয়ে মেয়েরা ছিল না। নিজেদের হাতে তৈরি হালুয়া, গজা, সন্দেশ, লুচি আলুরদম, আচার, মোরব্বা সব রকম খাবার পাওয়া যেত মেলায়। একদল ছেলে দোকানে দোকানে গান গেয়ে পয়সা উপার্জন করত। একবার একদল ছেলে এক প্রত্নতত্ত্বাগার খুলেছিল। সেখানে রামের পাদুকা (প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পাদুকা) অশোকের হস্তলিপি( জনৈক ছাত্রের নাম অশোক তার হাতের লেখা), বুদ্ধের পাদনখকণা( জনৈক ছাত্র বুদ্ধদাসের পায়ের নখ) ইত্যাদি দিয়ে প্রত্নতত্ত্বাগার সাজিয়েছিল। তাই দেখতে সেখানে ভীড় জমে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এক দোকান থেকে পোকায় খাওয়া একটা বেল একটাকা দিয়ে কেনায় মেলায় ফলের বাজার দর বেড়ে গিয়েছিল। এমন সব মজার মজার ঘটনা। তখন আনন্দবাজারের কোনো নির্দিষ্ট দিন ছিল না। এখন প্রতিবছর আনন্দবাজার বসে মহালয়ার দিন। মেলা শেষ হতেই শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে বেজে ওঠে, ‘ছুটির বাঁশি’। ছাত্রছাত্রীরা ছোটে যে যার ঘরের পানে, নিমেষে আশ্রম ফাঁকা হয়ে যায়। বর্তমানে করোনা আবহে শান্তিনিকেতন আশ্রমের উৎসব অনুষ্ঠান থেকে মানুষের কর্মচঞ্চলতা সব স্তব্ধ। রবীন্দ্রসংগ্রহশালা রবীন্দ্রভবন, কবির আবাস উত্তরায়ণ বন্ধ, অন্যদিকে ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, গৌরপ্রাঙ্গণ আশ্রমের ভিতর প্রবেশের অনুমতি সাধারণের নেই, সে কারণে শান্তিনিকেতন দর্শনে রবীন্দ্রানুরাগী মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
সম্প্রতি তিন ছাত্রের বহিষ্কার নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কিছু ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপকের বিরোধ তুঙ্গে, ফলে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আতঙ্কের মধ্যেও শান্তিনিকেতনে এক অশান্তির ছায়া। এমনিতেই মানুষ প্রায় দু’বছর গৃহবন্দি থাকায় স্বাভাবিক জনজীবন ব্যহত, সকলে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ক্লাস বন্ধ, ছাত্রছাত্রীরা দিশাহীন। সেখানে শাস্তি প্রয়োগে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি প্রশাসন মানবিক হবেন সেটাই সকল স্তরের মানুষ আশা করেন এবং রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসন ছাত্রছাত্রী অধ্যাপকদের মতবিরোধ কখনই আদালত মুখী হওয়া কাম্য নয়। শ্রদ্ধা বিশ্বাস ভালোবাসার বাতাবরণে আলোচনাই একমাত্র সমস্যা সমাধানের পথ বলে প্রবীণ আশ্রমিক থেকে স্থানীয় মানুষজন মনে করেন।
সেপ্টেম্বর মাসের দিনিলিপি লিখতে বসে রবীন্দ্রস্নেহধন্য দুজনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় এবং বিশ্বভারতী পর্বে প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী যাঁদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের গভীর নাড়ির যোগ ছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র সুকুমার রায়। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত। তাঁর লেখা ‘টুনটুনির বই’, ‘ছোটোদের রামায়ণ’ যে শিশু পড়েনি তার শৈশব এক কাল্পনিক নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তেমনি সুকুমার রায়ের ‘আবোল-তাবোল’, ‘পাগলা দাশু’, ‘অবাক জলপান’, ‘হ-য-ব-র-ল’, ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ প্রভৃতি কবিতা, গল্প, নাটক শিশু সাহিত্য জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। উল্লেখ্য, সুকুমার রায়ের পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুকুমার রায়কে খুব স্নেহ করতেন। রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় অনার্স পাশের পর সুকুমার রায় উচ্চশিক্ষালাভের জন্য বিলেতে গেলে সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রবীন্দ্রনাথ তখনও ‘নোবেল প্রাইজ’ পাননি। বিদেশে সাহিত্য আলোচনা থেকে নিকটবর্তী দেশ ভ্রমণে অনেক সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হয়েছিলেন। এক আসরে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর লেখা প্রবন্ধ আলোচনার সময় রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও পিয়ার্সন, সস্ত্রীক আর্নোল্ড, রোটেনস্টাইন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও অচেনা বহু মেমসাহেব উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এক ভোজসভায় রবীন্দ্রনাথ ও রোটেনস্টাইনের উপস্থিতিতে তাঁর নিজের লেখা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনালে রবীন্দ্রনাথ সহ সকলেই খুব প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এ-হেন মধুর সম্পর্ক ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের বিয়ের সময় তিনি শিলাইদহে জমিদারীর কাজে ব্যস্ত থাকবেন, সে কারণে বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। কিন্তু বিয়ের দিন সন্ধ্যায় বিয়ের আসরে হাততালি শোরগোল হওয়ায় সবাই দেখেন রবীন্দ্রনাথ শশরীরে উপস্থিত। এ-থেকে অনুমান করা যায় তিনি সুকুমারকে কতখানি স্নেহ করতেন। সুকুমার যখন শান্তিনিকেতনে আসেন তখন পুত্র সত্যজিৎ রায়ের বয়স মাত্র দু’বছর। তিনি তাঁর রচিত ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ গান শুনিয়ে ছাত্রছাত্রী থেকে আশ্রমিক সকলকেই প্রভূত আনন্দ দিয়েছিলেন। ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ গানের একটি লাইন, “ওরে ভাই, তোরে তাই কানে কানে কই রে, ওই আসে ওই আসে,ওই ওই ওই রে।” আশ্রমে সুকুমার রায়ের মুখে এই গানটি শোনার পর ছেলেদের কাছে তাঁর নামকরণ হয়ে গেল ‘ওই আসে’। একটি ছোটো ছেলে মাঠের গর্তে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারছিল না। সে দেখে সুকুমার রায় নিকট দিয়ে যাচ্ছেন। সে চিৎকার করে বলল, “ও, ‘ওই আসে’ আমাকে একটু তুলে দিয়ে যাও তো।” ১৯২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়।
বিশ্বভারতীর সূচনা পর্বে সৈয়দ মুজতবা আলী সুদূর শ্রীহট্ট থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে এসে ভর্তি হন কলেজে। প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কী পড়তে চাও?” উত্তরে মুজতবা আলী বলেছিলেন, “তা তো ঠিক জানিনে তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই।” পড়া শুরু হল, রবীন্দ্রনাথের কাছে শেলি, কীটস আর বলাকা কাব্যগ্রন্থ। একই সাথে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়ভাষায় শিক্ষাচর্চা। পরবর্তীতে বিশ্বভারতীতে ইসলামিক স্টাডিজ় বিভাগের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, অনুবাদক হিসাবে বিশেষ খ্যাত এই মানুষটি। সদালাপী, মিশুকে খুব রসিক মনের মানুষ ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে তাঁর গৌরবর্ণ সৌম্যকান্তি চেহারা, সাইকেলে চলেছেন এমন ছবি শান্তিনিকেতনে অনেকেরই মনে থাকার কথা। প্রবীণ আশ্রমিক, বিদগ্ধ মানুষজনের সঙ্গে শান্তিনিকেতন কালোর দোকান ছিল তাঁর আড্ডার জায়গা। সৈয়দদার সরস মন্তব্যে আসর থাকত জমজমাট। ১৩ সেপ্টেম্বর(১৯০৪) তাঁর জন্মদিন। শান্তিনিকেতনের দুই শ্রদ্ধেয় আপনজনের প্রতি রইল আমার আন্তরিক বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
শান্তিনিকেতন; ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১