Recent Post

শান্তিনিকেতনের দিনলিপি: শ্রীবাস বিষ্ণু

শান্তিনিকেতনের দিনলিপি: শ্রীবাস বিষ্ণু

শান্তিনিকেতনের দিনলিপি লিখতে বসে যে কথাটা মনে হচ্ছে, সেটা হল—  শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনে শ্রাবণ মাস রবীন্দ্রস্মৃতি তর্পণের মাস। এক বাইশে শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা দিনে বিশ্ববরেণ্য কবি,  আশ্রমের রূপ ও বিকাশের স্রষ্টা, সর্বোপরি এ যুগের শ্রেষ্ঠ মানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা চিরতরে হারিয়েছিলাম। গুরুতর অসুস্থতার কারণে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন সকল ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, কর্মী থেকে আশ্রমবাসী অশ্রুসিক্ত নয়নে আশ্রমসংগীত “আমাদের শান্তিনিকেতন সে যে সব হতে আপন”— গানটি গাইতে গাইতে গুরুদেবকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলেন। বিদায়কালে ক্ষণিকের তরে কবির চোখেও জল দেখা গিয়েছিল। হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন আশ্রম থেকে এই যাওয়া তাঁর শেষ যাত্রা। যাবার পথে শান্তিনিকেতনে ইলেকট্রিক পোল বসেছে দেখে বললেন, “এবার তাহলে পুরোনো আলো বিদায় নিল, নতুন আলো জ্বলবে।” 

শান্তিনিকেতনের দিনলিপি - Nabataru-e-patrika
শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ। ছবি: বিশ্বভারতীর সৌজন্যে

কলকাতার স্বনামখ্যাত চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে  শ্রাবণ (ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১) দুপুর ১২টা ১০মিনিটে জোড়াসাঁকোয় এক মহাজীবনের মহাপ্রয়াণ ঘটে। কবির জীবিতকালে তাঁর প্রবর্তিত বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ উৎসব দুটির কোনও নির্দিষ্ট দিন না-থাকলেও রবীন্দ্র তিরোধানের পর বাইশে শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ ও তার পরের দিন শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব  নির্দিষ্ট। তারই সঙ্গে চলে রবীন্দ্রসপ্তাহ, বর্ষামঙ্গল প্রভৃতি নানান অনুষ্ঠান।  রবীন্দ্রসপ্তাহ—সপ্তাহ ধরে রবীন্দ্রজীবনদর্শন ও তাঁর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা। শ্রাবণমাস জুড়ে এ সব অনুষ্ঠানের মমার্থ গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো অর্থাৎ কবির কথায় ও গানে তাঁকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করা।

প্রকৃতির কবি রবীন্দ্রনাথ গাছকে প্রাণের আদিম প্রকাশ রূপে দেখেছেন। পৃথিবীর বুকে গাছই প্রথম প্রাণকে আহ্বান করেছে। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর পূর্বপুরুষ হিসাবে বৃক্ষবন্দনাকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন। বৃক্ষবন্দনা মানেই প্রাণের তর্পন। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “তাদের ভাষা হচ্ছে জীবজগতের আদিভাষা, তার ইশারা গিয়ে পৌঁছয় প্রাণের প্রথমতম স্তরে; মনের মধ্যে যে সাড়া ওঠে সেও ঐ গাছের ভাষায়— তার কোনও স্পষ্ট মানে নেই, অথচ তার মধ্যে বহু যুগযুগান্তর গুনগুনিয়ে ওঠে।”       

প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ ১৯২৮ সালে বিশ্বভারতীর জীবনে দুটি ঋতুউৎসবের সূচনা করেছিলেন। ২১ জুলাই শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব, পরের দিন শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব। বৃক্ষরোপণ উৎসবের ভেতরের কথাটি হল— উদ্ভিদ প্রাণহীন জড়-পৃথিবীকে শ্যামল সুন্দর করে তোলার কঠিন ব্রত গ্রহণ করেছে। তার অস্তিত্বর মধ্যে প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার বীজমন্ত্র। আজ মানুষ বুঝতে  পেরেছে একটি গাছ একটি প্রাণ। তাই মানব সমাজের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রাবণমাস এলেই দেখি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পাড়ায়, গ্রামে বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন। সেই আদর্শে চারিদিকে বনমহোৎসবের শঙ্খধ্বনি। রবীন্দ্রনাথই তার পথপ্রদর্শক। দ্বিতীয় হলকর্ষণ বাঙালি জীবনে প্রতীকী এক শুভ উৎসব। একদিকে প্রকৃতি বন্দনা তো অন্যদিকে কৃষিকার্যে  গ্রামের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং সামাজিকতা— এই লক্ষ্য নিয়েই রবীন্দ্রচিন্তায় হলকর্ষণ এক মাঙ্গলিক উৎসব। আজ  সমগ্র বিশ্বে যন্ত্রের দাপট বেড়েছে। মানুষ কলের দাসত্ব গ্রহণ করেছে। কল মানুষকে চালনা করছে বলেই দিন দিন পৃথিবীতে প্রাণের ক্ষয় বাড়ছে।  কবির আশঙ্কা এর ফলে প্রকৃতি যদি মানুষের প্রতি তার অকৃপণ ভালোবাসার মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে একদিন পৃথিবীর বুকে মানবজীবনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই হলকর্ষণের গান, “ফিরে চল্, ফিরে চল্, ফিরে চল্ মাটির টানে। যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।” এ কেবল হলকর্ষণের সংগীত নয় বর্তমান বিশ্বে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এ গান সর্বজনীন। বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ উৎসবের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সান্নিধ্যলাভ তার অকৃপণ দানের কথা বলে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন।  

শান্তিনিকেতনের দিনলিপি ১ - Nabataru-e-patrika
শান্তিনিকেতনের দিনলিপি – Nabataru-e-patrika

প্রথমবার বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়েছিল উত্তরায়ণের উত্তর দিকের প্রাঙ্গণে। পাঁচটি চারাগাছ রোপণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে বৃক্ষরোপণ উপলক্ষ্যে পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে এক চিঠিতে লিখছেন, “…তোমার টবের বকুলগাছটাকে নিয়ে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটা হলো। পৃথিবীতে কোনো গাছের এমন সৌভাগ্য কল্পনা করতে পার না। সুন্দরী বালিকারা সুপরিচ্ছন্ন হয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞক্ষেত্রে এল—শাস্ত্রী মহাশয় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন—আমি একে একে ছ’টা কবিতা পড়লুম—মালা দিয়ে ধূপধুনো জ্বালিয়ে তার অভ্যর্থনা হল।” ছ’টি কবিতার মধ্যে পাঁচটি পঞ্চভূতের উদ্দেশে— ক্ষিতি, অপ্‌, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্‌ ষষ্ঠটি মাঙ্গলিক।  সেবার প্রথম গাওয়া হয়েছিল “মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে” গানটি। পরের বছর ১৯২৯ সালের ১০ আগস্ট শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত হল বৃক্ষরোপণ পরদিন শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব। এবছর কবি  হলকর্ষণের নূতন নাম দিলেন ‘সীতাযজ্ঞ’। পূর্বেই বলেছি কবির জীবিতকালে বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ উৎসবের  কোনও নির্দিষ্ট দিন ছিল না। রবীন্দ্র প্রয়াণের পর  বৃক্ষরোপণ দিনটি রবীন্দ্র তিরোধান দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ভাবনা এই দিনে এক মহাপ্রাণের যেমন প্রস্থান তেমনি একটি শিশুবৃক্ষ রোপণের ভিতর দিয়ে নবপ্রাণের আবির্ভাব। সেই ধারা অনুযায়ী প্রতিবছর ২২শে শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ পরের দিন শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব এবং সাতদিন ধরে রবীন্দ্রসপ্তাহ পালনের মধ্য দিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় শান্তিনিকেতনে ‘রবীন্দ্রস্মরণ’ অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে।    

এ বছর  ‘করোনা’ আবহে কবির জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ পালন করা যায় নি। কিন্তু বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্র তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে কোভিড-১৯ এর সমস্ত নিয়ম মেনে সকালে উপাসনা, বৃক্ষরোপণ এবং তার পরদিন শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়েছে। উভয় অনুষ্ঠানেই বিশ্বভারতীর উপাচার্য অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী পৌরোহিত্য করেন। বৃক্ষরোপণ উপলক্ষ্যে সকালে শান্তিনিকেতন মন্দিরে উপাসনা এবং বিকেলে উত্তরায়ণে একটি পাইন বৃক্ষ রোপণ করা হয়। উপস্থিতির সংখ্যা ছিল সীমিত। কোনও অনুষ্ঠানই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। করোনার কারণে এ-বছর রবীন্দ্রসপ্তাহ পালন করা সম্ভব হয়নি। এ-বছর স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষ উপলক্ষ্যে বিনয়ভবনে বিশ্বভারতী ক্রীড়াবিভাগের মাঠে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ভিতর দিয়ে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়। সন্ধ্যায় স্বদেশী সংগীতের আসর। উল্লেখ্য,  এ-বছর রবীন্দ্রনাথের আশিতম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনের আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধার সঙ্গে  বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন করেছেন। শান্তিনিকেতন এন্ড্রুজপল্লীতে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসভবন ‘আনন্দধারায়’ পালিত হয়েছে বৃক্ষরোপণ। বৃক্ষরোপণ করেন পাঠভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুর। 

শান্তিনিকেতন

(২০ অগস্ট, ২০২১; ৩ ভাদ্র, ১৪২৮)

Author

  • শ্রীবাস বিষ্ণু

    শ্রীবাস বিষ্ণু শান্তিনিকেতনের খবরাখবর নিয়ে কলম ধরেছেন। 'শান্তিনিকেতনের দিনলিপি' নামে এই খবর ধারাবাহিক ভাবে নবতরু ই-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

    গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

      আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

        মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন