লাবণ্য: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
কাল রাখাল রাজা মাঠে অর্কেষ্ট্রা ছিল। প্রোগ্রাম থেকে বাড়ি আসতে প্রায় রাত তিনটে বেজে গিয়েছিল লাবণ্যর। বিছানা মশারি ওর ঠাকুমা সব কিছু ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে টাঙিয়ে রাখে। লাবণ্যর শুধু মশারি একটু ফাঁক করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরা। সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার কোনও ব্যপার ছিল না আজ, হঠাৎ মশারির চালে ঝটপট শব্দে লাবণ্যর কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। কোনও রকমে চোখের পাতা হাতের আঙুল দিয়ে টেনে ওপর দিকে চেয়ে দেখল, ‘চিনা’ তার দিকে ঝটপটিয়ে প্যাক প্যাক করে ডাকছে।
সত্যিই তো রিষ্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে লাবণ্য দেখল, সকাল আটটা বাজতে চলেছে। এখনো চিনার সকালের প্রাতরাশ খাওয়া হয়নি। দোষ নেই ওর, আর সেই যে চোখ না ফোটা থেকে লাবণ্যর হাতে খাওয়া অভ্যেস, কিছুতেই ঠাকুমা বা অন্য কারো কাছে খাবে না। তাই উপায় না থাকায় উঠতেই হল লাবণ্যকে। মশারির বাইরে আসতেই চিনা ঝটপটিয়ে প্যাক প্যাক করে এসে লাবণ্যর হাতে বসলো। ঘরের বাইরে এসে দেখল কী খাবার আছে, পুকুর থেকে ওঠানো কিছু গুগলি আছে। ঠাকুমার কাছে এক বাটি ভাত নিয়ে, গুগলি ছেঁচে লাবণ্য চিনাকে খেতে দিল। চিনা এখন খুব খুশি। প্যাক প্যাক করে এক পেট ভাত, গুগলি খেয়ে গলা ফুলিয়ে ফেললো। এরপর আবার খিরকি দরজা অবধি এগিয়ে দিতে হবে। তবে চিনা উড়তে উড়তে গিয়ে বাম পুকুরে ঝাঁপ দেবে।

চিনা ছাড়া লাবণ্যর আরো দুই পোষ্য আছে বাড়িতে। কালু কুকুর আর বিলু বেজি। বিলু বেজি মাছ খেয়ে তবেই যায় জঙ্গলে বেড়াতে। সেই ফিরে আসে বৈকালের আগে। কালু বাড়িতেই থাকে। রাতে রাতে ও লাবণ্যর কাছে খাবার বায়না করে। লাবণ্যর সংসারে তিন পোষ্য, ঠাকুমা আর ও নিজে। ওর কলেজের ছুটির পর কিছু প্রাইভেট টিউশনি আছে, বাড়িতেই পড়তে আসে। এছাড়া আছে ঠাকুমার উইডো পেনশন। দাদু পোষ্টঅফিসে চাকরি করতেন, কিছু নিজেদের চাষযোগ্য জমি আছে। এতেই লাবণ্যর ও ঠাকুমার সংসার চলে যায়।
একটা চাকরি হলে ভাল হতো। বিএ পাশ করে আজকাল চাকরি জোটানো খুবই কষ্টকর।
এখন গড্ডালিকা প্রবাহে ওর জীবন। চলছে…চলছে। এরপর কী হবে ভাল মন্দ কেউ জানেনা। গ্রামের লোকেরা লাবণ্যকে খুব ভালবাসে। কেননা ও অমায়িক, স্বল্পভাসি, উপকারি। গ্রামের প্রাণ বলতে লাবণ্য। কতদিকে তার ধ্যান। যে কোন উৎসবে, কেউ বিপদে, কেউ অসহায়, প্রতিবেশীদের ঝগড়া মেটানো সবেতেই লাবণ্য।
এইগুলো সবকথা নয়। সুস্থ সবল সচ্ছল পরিবার, রোজগার ঠিক সময়ে সবকিছু সাঙ্গ হওয়া, এইসব নিয়ে ভাবে লাবণ্যর ঠাকুমা। অনেকদিন পার হয়েছে, আজ এককালে ঠেকেছে। স্বামী পোষ্ট অফিসে কাজ করতেন। বদলির চাকরি ছিল, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়েছে জীবনে। অনেক অভিজ্ঞতা। একটি মাত্র ছেলে, সেও চেষ্টা করে পোষ্ট অফিসের চাকরি পায়। ঠাকুমা সময়েই ছেলের বিবাহ সম্পন্ন করেন। ভরপুর সুখের সংসার। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। এক অদৃশ্য কাঁটায় ছেলে-পুত্রবধূকে হারাতে হয়। তখন তার নাতির বয়স দুই। সেই থেকেই লাবণ্য কে মানুষ করেছেন। ধীরে ধীরে লাবণ্য বড় হয়ে উঠেছে। সামনে তার ভূত ভবিষ্যত। এই সায়াহ্নে ঠাকুমা আর কতদিন! আর তো দিন গোনার সময় এসে গেছে। এই জলের মত স্বচ্ছ সম্পর্ক, যার কোনও রূপ রং নেই, আরও কতদিন, ঠাকুমার বয়সই তা বলে দেবে।
ছন্দপতন ঘটল, যখন লাবণ্যর মামা একদিন ওদের বাড়িতে উপস্থিত হল।
—লাবণ্য…লাবণ্য… কোথায় সব। মাসিমা।
—কী ব্যাপার নিলয়…হঠাৎ? এসো…এসো…কী মনে করে? আজকাল তো প্রায় আসই না।
—হাঁ, এই মাসিমা এসে গেলাম। লাবণ্য কোথায়?
—লাবণ্য, এই একটু পাড়ায় বেরিয়েছে। এসে পড়বে। বোস…বোস সব কুশল সংবাদ তো?
—হাঁ – মাসিমা।
—বোস…বোস, ততক্ষণে তোমার জন্যে শরবত নিয়ে আসি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঠাকুমা শরবত নিয়ে এসে মামাকে দিলেন।
—খাও বাবা…।
দেখতে দেখতে লাবণ্য এসে হাজির।
—কী…মামা…কখন এলেন …কেমন আছেন? লাবণ্য মামাকে প্রনাম করল।
—এই তো লাবণ্য…কেমন… তোমার জন্যে এসেছি। আমার একদম সময় নেই, আজকেই আমার সাথে বেরুতে হবে।
—আজ কে… কী ব্যাপার নিলয়? ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে…!
—আমি যেখানে থাকি, ঝাড়খন্ডে, সেখানে লাবণ্যর চাকরি ঠিক করেছি। ওতো বিএ পাস করে বসে আছে। বয়স বাড়ছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
—হাঁ ঠিকই, তবে আজকেই?
—আজকে বেরুলে কাল পৌঁছাবো। গিয়েই ইন্টারভিউ। পরশু জয়েন। দেরি হলে ওরা অন্য লোক নিয়ে নেবে।
—তা ঠিকই। চাকরি বলে কথা। কেমন যেন ঠাকুমার বুক ছ্যাঁত করে উঠলো।
সেই কবে থেকে নাতিকে নিয়ে আছেন। চাকরির জন্য আজকেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে। তাছাড়া ঠাকুমা নাতির সঙ্গেও যেতে পারেন না এখন। এই মুহূর্তে বাড়িতে তালা দেওয়া সম্ভব নয়। যে ভাবেই হোক বুকে ব্যাথা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নাতিকে যেতে দিতে হবে।
পিতামাতাহীন ঠাকুমার কোলে লালিত- পালিত সেই ছোট্ট বালক এখন যুবক লাবণ্য। এই গ্রাম পল্লী কুটির থেকে রওনা হল মামার সাথে। ঝাড়খন্ডের এক অখ্যাত কয়লাখনির অফিসে তার চাকরি। বিদেশে চাকরির হাটে সে বিক্রি হয়ে গেল। মামার চোখে লাবণ্য এক দৈন্য, গ্রাম্য জীবন ছেড়ে সভ্য-ভদ্র আস্তানা পেল। মাস মাইনে, ধোপ-দূরস্ত জামা পড়ে লাবণ্য ডাঙায় উঠে পড়ল। ঝাঁ-চকচকে নিয়ন লাইটের আলোয় বদ্ধ অফিস ঘরে এখন সে বন্দি।
সানমাইকার টেবিল চেয়ার, ঘন- ঘন বেয়ারার চা-জল খাবার, সময়ে সময়ে বসের ডাক, আটটা পাঁচটা ডিউটি, গুডমর্নিং-গুডইভিনিং এর আবর্তে লাবণ্যর জীবন।
কিন্তু অন্যদিকে গোপন অশ্রুজল…তার বাঁধ কে দেবে!
লাবণ্যর জন্মভূমি, জীবনের অপূর্ব ভাবানুভূতি, গ্রামের নীরব নৈশ আকাশ, গ্রামছাড়া ময়দানের স্বপ্নমাখা দিগন্ত— এর কী হবে! শ্রাবণে সবুজ কার্পেট, অগ্রহায়ণে সোনালী ধান ক্ষেতে যত্রতত্র বিচরন লাবণ্যকে কে দেবে! স্বদেশ থেকে বহুদূরে, মা-সম ঠাকুমাকে ছেড়ে এই ককর্শ বন্ধুর কয়লাখনি অঞ্চলে একজন তরুণ যুবক, সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। বদ্ধ অফিস ঘরের জানালার সার্সি থেকে সান্ধ্য সূর্য- রক্তচ্ছটা, দূরে চোখ রেখে মনে পরে ভল্লুকা নদী তীরবর্তী তার জন্মভূমির কথা। তার ঠাকুমা আছেন সেখানে, চিনা, বিলু, কালুর অনুপস্থিতি নিত্য পীড়া দেয় তাকে। আবার কবে দেখা হবে তাদের সঙ্গে, কে জানে?
One thought on “লাবণ্য: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়”