লকডাউন: বিশ্বরূপ দাস
“বলি স্কুল যাবে, না বসে বসে বোতামগুলো টিপে যাবে। রান্নাবান্না তো করতে হয় না। করলে বুঝতে কত ধানে কত চাল হয়। বেরিয়ে যেত তোমার সকাল থেকে মোবাইল করা। তাও বুঝতাম, ছেলেটাকে যদি সকাল থেকে একটু নিয়ে মা স্বরস্বতীর কাছে ধূপ-ধুনো দিতে।”
সকাল থেকে গিন্নির এত তিরিক্ষি মেজাজ কেন তা বুঝতে না পেরে মিহি সুরে বললাম, “কেন? এইতো তোমার বাজার করে দিলাম। সকাল থেকে কাউকে গুড মর্নিং জানানো হয়নি বুঝলে। তাই সবে হাত দিয়েছে আর… “
“তোমাকে হাত দেওয়াচ্ছি, ওই হাতেই তো তুমি আমার সব সব্বনাশ করেছ! তোমাকে সহজে ছেড়ে দেব ভেবেছ। ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা আদায় করে ছাড়বো। বলি দেশের লোককে গুড মর্নিং জানানো হচ্ছে, আর আমাকে কোন দিন কোনও কালে উইশ করেছ?”

দুরু দুরু বক্ষে মনে সাহস নিয়ে বললাম,
“কেন বিয়ের আগে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা রাত্রে কতবার কতভাবে ওইসব করেছি মনে নেই। সেবার তো কৃষ্ণসাগর পার্কে তোমার বাবার চোখে ধরা পড়ে কী কেলোটাই না হয়েছিল।”
—”ওহ! বাবুর আবার পুরনো প্রেম উথলে উঠলো। বলি নতুন কোন কাব্য টাব্য লিখছো নাকি। না লুকিয়ে চুড়িয়ে আবার কারো সাথে প্রেমালাপ চলছে । শুনেছি মধ্য যৌবনে টেস্টেস্টেরনগুলো খুব সজাগ হয়ে ওঠে। আমার বাপু তোমাকে বিশ্বাস হয় না। তবে একটা কথা বলে রাখি সেরকম কিছু যদি হয় আমি কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়বো।”
—”গিন্নি, কুরুক্ষেত্র বানাতে গেলে তোমাকেও দ্রৌপদী হতে কিন্তু। একবার ভেবে দেখো আড়ালে আবডালে থাকা তোমার দেবরগুলো গোবর মারিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখবে এক এক করে গোলাপের পাপড়ির মত খুলে যাচ্ছে….”
—”তুমি একটা আস্ত শয়তান, অসভ্য কোথাকার।”
—”আরে আরে রাগছ কেন? আমি তো তোমার রূপের কথা বলছিলাম সুন্দরী। মনে নেই কলেজের সোশালে তোমার টি-শার্টে “Beauty Begins” দেখে আমার মনের কী অবস্থা হয়েছিল! সারারাত অর্জুনের মত লক্ষ্যভেদ করার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম।”
—”চুপ চুপ, ছেলেপুলে শুনতে পাবে। বুড়ো হয়ে তোমার ভীমরতি গেল না। বলি হ্যাঁ-গো এবার পুজোয় কোথায় শপিং করতে যাবে?”
—”শান্তিপুরে।”
সঙ্গে সঙ্গে গিন্নি কালবৈশাখীর মেঘের মতো গর্জে উঠে বলল, “এত জায়গা থাকতে শান্তিপুরে কেন? ওহ! ওখানে বুঝি মশায়ের ফেবুর সেই রূপসী থাকে। তাই দিনরাত খালি ফ্রিঙ ফ্রিঙ করে এত মেসেজ আসে। আমাকে লুকানো, দাঁড়াও হাতেনাতে ধরতে যদি পারি তাহলে তোমার নেতার মেরে ছাড়বো।”
আমাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে সোজা ব্যাটিং করে যাচ্ছে দেখে আমি ছোট্ট একটা গুগুলি ছুড়ে দিয়ে হাসি মুখে বললাম, “এই, এখন একবার হবে?”
শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো, “কি সব্বনেশে কথা, এই সাত সকালে, আ-মরণ! দেখে বাঁচি না।”
— “আহা! চটছ কেন? আমি তো চায়ের কথা বলছিলাম। তোমার মন দেখছি সবসময় পুলিশ পুলিশ।”
—”কি বললে আমি ফুলিশ?”
—”না না আমি তোমাকে ফুলিশ বলতে যাব কোন দুঃখে, আমার ঘাড়ে তো আর দশটা মাথা নেই। আমি দশানন নই। তবে দশ সন্তানের জনক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে বাড়া ভাতেও ছাই পড়ল। ওই এক-এ-চন্দ্র, আর দুইয়ে-পক্ষের পর আর যে কোনো নামতা হয় তা তুমি আজ পর্যন্ত শিখলে না। সব সময় ট্রাফিক পুলিশের মত আমাকে রেড সিগনাল দেখিয়ে গেলে।”
সঙ্গে সঙ্গে গিন্নি তার সযত্নে লালিত সফেদ দন্তগুলি বিকশিত করে ঈষৎ শ্লেষ মিশ্রিত গর্বিত কন্ঠে বলল, “তোমাদের মত পুরুষকে এভাবে রেড সিগন্যাল না-দেখালে বাঁকা পথে উঠে গিয়ে যে কোনও সময় এক্সিডেন্ট করে বসবে। তখন পরের দায় কে সামলাবে? তার চেয়ে চলো দুজনে লুডু খেলি।”
—”বাহ! তুমি তো দেখছি আজকাল বেশ ইনটেকচুয়াল কথা বলছ। আমি তো ভেবেছিলাম সাত পাকে বাঁধা পড়ার পর তোমার বুদ্ধিগুলো সব শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে। কথায় কথায় তাই শুধু দাউ দাউ আগুন।”
—”কি, আমি ঘুঁটে? মানে বোকা? আর তুমি তক্করত্ন, দিগ্বিজয়ী মহা পন্ডিত, বিদ্যাসাগর! তাই একই স্কুলে ২৩ বছর। দিতে হত আজকের মতো এসএসসি পরীক্ষা। তাহলে বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই-এর মতো তোমার বুদ্ধি সবাই দেখতে পেত।”
—”বলি খেপছো কেন? কে বলেছে সোনা, তোমার বুদ্ধি নেই? তুমি রূপে ঐশ্বর্য রায়, গুণে লাভলিনা আর বুদ্ধিতে আমাদের পিসি…থাক আর বললাম না।
তোমার মতো শপিং স্পেশালিস্ট, বিউটি পার্লার ফ্রেন্ডলি, পিএমপিসির ইঞ্জিনিয়ার আর ক’জন আছে? তাছাড়া রান্নার হাতটা তোমার মন্দ নয়। আবার কীর্তনের গলাটাও অসাধারণ। যা শুনে পাশের বাড়ির কাকাবাবু দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে গতকালই বৃন্দাবনে চলে গেছেন। হ্যামিলনের বাঁশির মতো তোমার সেই অমায়িক সুর আমাকে একবার শোনাও। শুনতে শুনতে আমিও ব্রজে চলে যাই। প্রেম যমুনায় অবগাহন করে জীবন সার্থক করি।”
মশায়, তারপর দুদিন কি হয়েছিল আর জানতে চাইবেন না। অভুক্ত পেটে বিরহ বদনে বসে আছি একা ঘরে।
আজ স্কুল যাওয়া হবে না। ভুলেই গিয়েছিলাম লকডাউন চলছে। মনে হচ্ছে এবার অনির্দিষ্টকালের জন্য টোটাল লকডাউন।
খুব সুন্দর উপস্থাপন এবং সম্পাদনার জন্য সম্পাদকমন্ডলী কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
একটা ই-পত্রিকা এত সুন্দর হতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না। এই কৃতিত্ব নবতরু পত্রিকার সাথে যুক্ত সমস্ত কলাকুশলীদের প্রাপ্য।
সত্যি ভীষণ ভালো লাগলো। আমি আপ্লুত এবং অভিভূত