যা দেখি – বরুণ মুখোপাধ্যায়
দেখতে দেখতে নভেম্বরের শেষে ডিসেম্বর এসে পড়েছে। জমকালো শীত এখনও না পড়লেও দোকানে বাজারে শীতের পোষাকের পসরা সাজানো। সাইকেলে চাপিয়ে লেপ কম্বল চাদর বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালা সেই পুজোর পর থেকেই খুব ব্যস্ত। মটর ভ্যানে আধুনিক মেশিন আর তুলো ভরা বস্তা নিয়ে গ্রামে গ্রামে লেপ তোষক তৈরির আয়োজন চলছে নিয়ম করেই। পাশের এলাকার শিউলিরা খেজুর গাছগুলোও পরখ করে গেছে দু-এক বার। সকলেই ভীষণ শীতের অপেক্ষায় দিন গুনছে। স্টেশনে ট্রেনের আনাগোনাও শুরু হয়েছে কিছু। স্টেশন কিশোরী তার মায়ের কোলে ভাই আর একহাতে ধরে থাকা বোনটার দিকে তাকিয়ে ভাবে ভীষণ শীত এলে কী করবে এবার। এবারও কি সেই লোকটার বাড়িতেই আশ্রয় নিতে হবে তাদের?
এদিকে নবান্নের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে গ্রামের মোড়ল শিবতলায় বসে আছে ছেলেপুলেদের আসরে। সেই তো প্রতিবছর নবান্নের দিন ঠিক করে। তাকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে কলার কাঁদির দর-দাম, লাভ-ক্ষতির হিসাব। কিছুদিন আগে পর্যন্তও নাকে মাস্ক লাগিয়ে তারা যেত দূরের বাজারে। এখন এই পরিস্থিতির জন্য রাজনীতিকেই দায়ী করে বুড়ো।
এখনও ছাত্রছাত্রীহীন স্কুলবাড়িটায় পুজোর ফুর্তির নিদর্শন, যত্রতত্র প্লাস্টিক প্যাকেট পড়ে আছে। বাথরুমের পাশেই নোংরা আবর্জনা। ক্লাবের দাদারা যে বলে রেখেছিল পুজোর সময় যেন স্কুলের গেটের তালা খোলা রাখা হয়। এরপর নবান্ন, তাই তারা নবান্নেও কিছু করে দেখাবে।

যাক এবার পুজোয় চাঁদা কিছু কম লেগেছে, নবান্নের বেলায় পুশিয়ে না নেয়! বড় বড় ছাগলগুলো বারকয়েক ছাড় পেলেও এ যাত্রায় তাদের আর রক্ষে নেই। মাস ছয়েক বাজার মন্দা থাকায় পাইকার প্রায় আসেইনি গ্রামগুলোতে। আগের বছর ধর্মরাজ পুজোয় দু-কুইন্টালের উপর মাংসের অর্ডার সাপ্লাই করেছিল ব্রিজের নীচের মাংস বিক্রেতা, এবছর ওই সময়টা ভোঁ-ভাঁ। ছাগলগুলো বাড়তি লাইফ পেল বটে! তাই স্কুলে সদ্য বেড়ে ওঠা কদম আর সুপারিকে মাথা তুলে দাঁড়াতেই দেয়নি ওরা।
মাসে একবার করে আসা মাস্টারমশাইরা চাল আলু আর একটু ভালোবাসা মেপে দিয়ে যান নিয়ম করে। মাপ শেষে ওজন যন্ত্রটা মাথায় তুলে প্রতিবারই বয়ে নিয়ে যেতে ভালোবাসে পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়া ছাত্রটি। পৌঁছে দেয় ফার্স্ট বয়ের বাড়ি, সঙ্গে তার সামগ্রীও দিয়ে আসে। এগুলো নিতে আসতে বাবুর সময় নেই। আসলে এর থেকে বেশি চাল তার বাড়ির হাঁস-ছাগলে খায় রোজ।
ক্লাবের ছেলেরা এবার মাস্টারমশায়দের থেকেই পুরো চাঁদাটা না হেঁকে বসে! সরকারেরও খেয়েদেয়ে কাজ নেই। এইভাবে মাসের পর মাস বসিয়ে বসিয়ে মাইনে?
রেশন দোকানে মাসিক সামগ্রী নিতে না নিতে চাল আর ময়দা চলে যায় সাইকেল চেপে অন্যত্র। এদিকে জ্বরে খোকার মুখে রুচি নেই বলে খোকার বাবা দোকানে লাইন দিয়ে ময়দা কিনে আনে।
তাড়াতাড়ি ধান বাগিয়ে লবান(নবান্ন) করে নিলে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে ঠেঁসে লবান, পান্ত-লবান, বাস-লবান খাওয়া যাবে। এই লোভে মোড়ল কোথায় যেন ফোনে খোঁজ নেন, “ওগো, তোমাদের লবান কঁয়ো?”
আঞ্চলিক উৎসবের কথায় অনেক কিছু মনে পরে যায়।