যা দেখি(২য় পর্ব) – বরুণ মুখোপাধ্যায়
গ্রাম-বাংলায় অঘ্রাণ মাস মানেই ধান কাটা, ধান তোলা আর ধান ঝাড়াইয়ের শব্দ-গন্ধ, সেই সঙ্গে ঘরে ঘরে নবান্নের ধুম। নবান্ন শুধু আর নতুন ধানের উৎসবই নয় নবান্ন কোনও কোনও জায়গায় তা রীতিমতো জাঁকজমকপূর্ণ গ্রাম্য বাৎসরিক উৎসবের চেহারা নেয়। বাড়িতে আত্মীয়-কুটুম্বাদি আসেন, চলে দেদার খাওয়া-দাওয়া। লৌকিক উপাচার তো আছেই সেই সঙ্গে আয়োজন করা হয় নানান অনুষ্ঠানের, চলে তারস্বরে চেঁচিয়ে চলা শব্দদানবের একঘেয়ে আওয়াজ; গানের ‘গ’ শোনা ভার, কেবল একনাগাড়ে শব্দ সৃষ্টিই যেন এর মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু বছরের এইরকম কতিপয় উৎসব অনুষ্ঠানে নতুন গান আমদানি হয় কিছু। প্রতিবছরের মতো নবান্ন ফেরত পেটে চাল-কলা-চাঁছি আর এবারের বাড়তি পাওনা বলতে গলায় ‘টুম্পা সোনা’ নিয়ে কচিকাঁচারা যে-যার বাড়ি ফিরে গেল। এরপর এল হাড়কাঁপানো শীতের মাস পৌষ।

পৌষ মানেই ইন-জেনারেল পিঠেপুলি আর পায়েসের মাস, পৌষ মানেই শাল-সোয়েটার-টুপি, নানান বাহারি ফুল, মেলা, পিকনিক, স্নান না করার বাহানা, পুরোনো দিনের উনুনপারে বসে আগুন পোহাবার ছবি, বড়দিনের কেক, বেকারির খাবার বিক্রি করতে আসা বুড়োটার লাঠি ঠেকা দিয়ে দাঁড় করানো অসহায় সাইকেল, ঝুপ করে নামা সন্ধে, সেই গোরুর গাড়ির চাকার ধুলো, রাস্তায় রাস্তায় পাহাড় প্রমাণ ধানের উড়ুলি, বিকালে খেলা শেষে সরের বনে আগুন জ্বালিয়ে হুল্লোড়, গ্লিসারিন সাবানের গন্ধ, কানের পিছনে লুকানো জমা ময়লা, লেপের ওম, ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া আরও কত কিছু!
শহুরে পৌষ আসে বেলা করে দোকান খুলে, শীত পোষাক ঝুলিয়ে। সেখানকার পৌষ মানে আপাদমস্তক ঢেকে টিউশন পড়তে আসা কিশোর-কিশোরীর মুখের টাটকা গরম ধোঁয়া, ছাদে ওড়া কটস-উলের নাইটি, নকল খেজুর গুড়ে আসলের বিজ্ঞাপণের মতো আরও কত কিছু!
নব্য পৌষ আসে সর্ষেক্ষেতের পটভূমিতে সেলফি সাথে। শেষ বিকালে মাঠের পর মাঠে জ্বলে নাড়া পোড়ার আগুন, টি-টোয়েন্টি ধাঁচের বিকালে মাঠে বসে চলে ফ্রি-ফায়ার।
আর তাদের কাছে পৌষ মানে?
তাদের কাছে পৌষ মানে জবুথবু হয়ে বেঁচে থাকা, ময়লা ছেঁড়া জামা আর সারা শরীরে জমে থাকে একরাশ শীত থেকে বাঁচতে চাওয়ার চেষ্টা। পাশ দিয়ে হেঁটে যায় উষ্ণ পৌষ মাখা ব্যস্ত জীবন। এই তো আমার পৌষ!
প্রথম পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।