Recent Post

মোবাইল বনাম দাম্পত্যের লড়াই: ত্রয়ী

মোবাইল বনাম দাম্পত্যের লড়াই: ত্রয়ী

পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে বাসটা হু-হু করে ছুটছে, জানলা দিয়ে বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপট রিমির চুলগুলোকে 

বাঁধনহীন করতে চাইছে। গাড়ি ছুটছে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে, তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।

রিমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের সাথে আচেনা আজানা সেই স্বপ্নের রাজ্যে ভ্রমণ করার জন্য। কিন্তু রিমি খুব কষ্ট পায় তার স্বামী অর্ণব কে দেখে, সে বাসে উঠে থেকে সেলফোনে ব্যস্ত। কখনও হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক আবার কখনও গেম খেলায় মত্ত। রিমির চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সে অর্ণবকে কিছু না-বলে আভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। 

এটা শুধু রিমি বা অর্ণবের গল্প নয় এটা বোধহয় আমাদের সবার গল্প। আমাদের দাম্পত্য জীবনে সেলফোন কী প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটা এবার বোধহয় ভাবার সময় এসে গেছে। সত্যি বলতে কী আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে এর প্রভাব মারাত্মক। এই সম্পর্কে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালোবাসা থাকলেও ভালোবাসার গভীরতা থাকে না। ভালোবাসার অস্তিত্ব শুধু এক মাস, ছয় মাস বা এক বছরের নয়, সারা জীবনের জন্য, সবসময় পাশে থাকার অনুভূতি। হাজার মানুষের ভিড়েও দুজন ভালোবাসার মানুষ কোনও কথা না-বলেও দুইজনের মনের কথা বুঝে নিতে পারে। সারা দিনের আপেক্ষার পর বাড়ি ফেরা, একান্তে কিছু মনের কথা বলা, সবার মাঝেও চোখের ভাষায় অনেক অভাব অভিযোগ করে ফেলা, এইসব মিলিয়ে তৈরি হয় ভালোবাসা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে একটা অদ্ভুত নির্ভরশীলতা থাকে। যা তাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। কিন্তু আমরা এইসব অনেকক্ষেত্রে ভুলতে বসেছি। এই অনুভূতিগুলো কী হারিয়ে যাচ্ছে না আমাদের মধ্যে থেকে? আমরা কী ভেবেছি এর জন্য দায়ী কে ? দায়ী হয়ত অনেক কিছুই। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সঙ্গী, আমাদের মোবাইলই এর জন্য দায়ী অনেকাংশে। মোবাইল একটি 

অত্যাধুনিক আধুনিক যন্ত্র তাই একে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা যায় না; প্ররোক্ষভাবে আমাদের মোবাইলের অপপ্রয়োগই আমাদের সকল সমস্যার জন্য দায়ী।

সেলফোন প্রকৃতপক্ষে আমাদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। এটা ছাড়া আমরা সবাই অসহায়। কিন্তু এখন মোবাইলের বেশি ব্যবহার জীবনে অভিশাপ ডেকে আনছে। আমরা স্বীকার করি বা নাই করি প্রত্যেকেই 

মোবাইলের দাসত্বের জালে জড়িয়ে পড়েছি। কোথাও না কোথাও এই যন্ত্রটি সুস্থ সম্পর্ক গুলোর ইতি টানছে। সুস্থ দাম্পত্য সম্পর্কে আমাদের জীবনের সব থেকে মূল্যবান উপহার হল একে অপরকে দেওয়া সময়, কিন্তু অতিব্যস্ততম জীবনে সেই সময়টাকেই ঠিকমতো কাজে লাগাতে ভুলে গেছি আমরা। সময় থাকলেও আমরা ওই বোতাম টেপা যন্ত্রটাকে যতটা সময় দিই পাশে বসা মানুষটাকে ততটা সময় দেওয়ার কথা ভাবিও না । আমরা মুখে বলি অথবা না-বলি সবার রোজকার জীবনেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। সারাদিন অফিস করে এসে একে অন্যের সঙ্গলাভ চাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেখানেও মোবাইল প্রভুত্ব করে। আমরা সব বুঝেও না-বোঝার ভান করে চলেছি।

এই ভাবেই নিরন্তর এই ঘটনা ঘটতে থাকলে আমরা একদিন খুব বড়ো বিপদের সম্মুখীন হয়ে উঠব। দিনের পর দিন যন্ত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে আমরা আমাদের মানবিক গুণগুলোর ধ্বংস ডেকে আনব, মূল্যবান সময় গুলোকে নষ্ট করে ফেলব, যা আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমরা বুঝতেই পারব না কখন আমরা যন্ত্রে পরিণত হব। মোবাইল এখন আমাদের কাছে টাইম পাসের একটা আনন্দদায়ক মাধ্যম। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ অথবা গেমগুলো আমাদের নিত্যকার রুটিন-এ পরিণত হয়েছে। ফোনের প্রতি এই নেশাগ্রস্ততা আমাদের নৈতিক ,মানবিক, সামাজিক অবনতি ডেকে আনছে। আমারা বুঝতে পারছি না কীভাবে কাছের মানুষ দূরে চলে যাছে, তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এর ফল স্বরূপ কখন কখন কারোর মধ্যে মানবিক আবসাদের জন্ম দিচ্ছে।

 ভাবলে খুব অবাক লাগে আজ থেকে কয়েক বছর আগে যখন এত অত্যাধুনিক যন্ত্রের আবিষ্কার হয়নি, আমাদের জীবন খুব ভালো ছিল। মানুষের জীবন এত জটিল ছিল না, মানুষ অনেক মানবিক ছিল, তাদের মধ্যে সম্পর্কগুলো সুস্থ, স্বাভাবিক ছিল। দাম্পত্য সম্পর্কগুলোও ছিল অনেক মধুর। আর এখন এই মোবাইলকেন্দ্রিক জীবনে আমাদের সেলফোনের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ জীবনধারার অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ভাবলে হাসি পায় ফোনের প্রতি আমাদের অ্যাডিকশন আমাদের দিয়ে কী না-করায়। ভাত বসিয়ে ভাত পুড়িয়ে ফেলি, বাচ্চাকে পড়াতে বসিয়ে নিজেরাই ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সকালেই ঘুম ভাঙলেই আগে ঠাকুরের মুখ দেখে উঠতাম এখন মোবাইলের মুখ দর্শন করে দিন শুরু হয়, বাথরুমে বসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় এই মোবাইলের পিছনে, কাজ থেকেও ফিরেও কথা বলার সময় নেই সেখানেও মোবাইল আগে বাকি সব পরে। রাতে শুতে যাওয়ার সময়ও মোবাইলে দুই-তিন রাউন্ড গেম খেলা, হোয়াটসঅ্যাপ-এ একটু গুডনাইট উইশ করা অথবা পারলে সিরিয়ালটাও দেখে নেওয়া তো আছেই। 

মোবাইলকে ঘিরে অভাব অভিযোগ, মান-অভিমানের শেষ নেই, মোবাইলের বিরুদ্ধে কী বিশাল অভিযোগের তালিকা। কিন্তু সে বেচারা কী করে? যারা এর প্রেমে পরেছে তারা যদি না-বোঝে তাহলে কী 

হবে? সত্যিই আমরা কি কোনোদিন বুঝব না এই যন্ত্রটার খারাপ দিকগুলো? কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে দিন দিন? আমরা এত নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছি, জানি না আমরা কবে এই মোহ থেকে বেরোতে পারব। এখনি সচেতনভাবে মোবাইলের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ থেকে নিজেদেরকে বের করে আনতে হবে, না-হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সুস্থ স্বাভাবিক সুন্দর জীবন যাপনের জন্য আমরা মোবাইলের অপপ্রয়োগ বন্ধ করব—এটাই হবে আমাদের নতুন বছরের নেওয়া অঙ্গীকার।

Author

  • Barun@Mukherjee

    নবতরু ই-পত্রিকার সম্পাদক বরুণ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৮৪ সালে। বীরভূম জেলার নানুর থানার শ্রীকৃষ্ণপুরের গ্রামের বাড়িতেই বড়ো হয়ে ওঠেন। আবাসিক ছাত্র হিসাবে বিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করেন বিশ্বভারতীর পাঠভবন ও উত্তর শিক্ষা সদনে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ বরুণ মুখোপাধ্যায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ভালোবাসেন লেখালেখি করতে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক চর্চা ও সৃজনশীল কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে সর্বদা যুক্ত রাখেন। নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টির উন্মেষ ঘটানোর জন্যই দায়িত্ব নিয়েছেন নবতরু ই-পত্রিকা সম্পাদনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

নবতরু-ই-পত্রিকা
প্রবন্ধ / নিবন্ধ অক্টোবর ২০২১,পূজা সংখ্যা

কায়দারা এবং নইকিদেবী: দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যায়

    গুজরাটের বর্তমান পাটন শহরে ছাবদা বংশের তথাকথিত শেষ রাজা সামান্তাসিমহার ভাতুষ্পুত্র মূলারাজা তাঁকে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করেন চালুক্য বংশের। এই চালুক্য ইতিহাসে সোলাঙ্কি রাজপুত নামেও পরিচিত যা অগ্নিকুল রাজপুতদের এক শাখা

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    নবতরু-ই-পত্রিকা
    প্রবন্ধ / নিবন্ধ অক্টোবর ২০২১,পূজা সংখ্যা

    নৈতিকতা ও বর্তমান পরিস্থিতি: ড. মাধব ঘোষ

      বেশীরভাগ মানুষ মনে করেন, আমাদের প্রচুর ধনসম্পত্তি ও ক্ষমতা থাকলেই জীবন সফল, কিন্তু আমরা সেসব পেলেও সন্তষ্ট হই না এবং আরও বেশি পাবার চেষ্টা করি ও প্রাপ্ত জিনিসগুলি হারিয়ে যাবার ভয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকি। 

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      নবতরু-ই-পত্রিকা দক্ষিণ কলকাতার বনেদি পুজো
      প্রবন্ধ / নিবন্ধ অক্টোবর ২০২১,পূজা সংখ্যা

      দক্ষিণ কলকাতায় বনেদি পুজো: পিনাকী সরকার

        দেশ ভাগের সঙ্গেই পাল্টে গিয়েছে অনেক বাড়ির পুজোর স্থান। ঠিক তার ব্যতিক্রম নয় বর্তমান দক্ষিণ কলকাতায় দ‌ত্ত বাড়ির দুর্গা পুজো। ওপার বাংলার পুজো এপার বাংলায়—অর্থাৎ ওপার বাংলার ঢাকা বিক্রমপুরে যে পুজো শুরু হয়েছিল সেটি এখন এপার বাংলার দক্ষিণ কলকাতায় সাড়ম্বরে পালিত হয় ।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন