[]এক[]
প্রচেতা ঘরের সব কাজগুলো সেরে সবেমাত্র বসল একটু বই নিয়ে ঘড়িতে তখন রাত একটা দশ। দু’দিন ধরে কলেজে যাওয়া হচ্ছে না মায়ের জ্বরের কারণে। তাছাড়া ওর স্টুডেন্টগুলোর সবার পরীক্ষা।
প্রচেতা অনন্তপুরের ছোট্ট এক মফস্বলের মেয়ে। ওর বাবা প্রোস্টেট ক্যান্সারে ক্লাস ইলেভেনে মারা যায়। তারপর থেকেই প্রচেতা অন্যরকম হয়ে যায়। সব সময় বই আগলে বসে থাকে। পড়াশোনা আর মা ছাড়া ওর জীবনে আর কারোর জায়গা নেই। জায়গা রাখতেও চায়না ও। মা ছাড়া ওর কাছে এ বিশ্ব অন্ধকার। প্রচেতা প্রেসিডেন্সিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। সামনের মাসে ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা। ওকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতেই হবে।

অনন্তপুর ওর কাছে একটা বদ্ধ জগত। যেখানে ওর জন্য আলোর প্রবেশ নিষেধ। সেই আলোর প্রবেশের জন্যই ও নিরন্তর দরজা খোঁজার চেষ্টা করছে। ওর মাকে লোকে যখন ‘ঝি’ বলে তখন ওর রাগে গা জ্বলে যায়। তবে আর বেশিদিন নেই সামনে আসছে ইচ্ছাপূরণের হাতছানি।
পড়তে পড়তে কখন রাত ঘনিয়ে এসেছে ওর খেয়াল নেই। ঘুপচি ঘরটার গাম্ভীর্য ভাঙল ওর মায়ের কথায়, ” হ্যাঁ রে মা, একটু ভাববি না তুই? অত ভালো সম্বন্ধ, না করার আগে একবার ভাব.. তোর মায়ের এই মর-মর অবস্থা.. ছেলে তো ভালো বাড়ির। তাছাড়া রেলে চাকরি… আর সব থেকে বড় কথা তুই যতদূর পড়তে চাস ওদের বাড়ি তোকে পড়াবে। তুই চাকরি-বাকরি করবি!”
শেষের কথাটা প্রচেতার কাছে বিদ্যুতের মত ঝলসে উঠল। যতদূর পড়তে চায় পড়তে দেবে! পড়াশোনার খরচ দেবে? ও তো পড়তেই চায় অনেক দূরের স্বপ্ন ওর…
“আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী!”
[]দুই[]
“বুড়ো লোকটার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই সে তো আমি আগে থেকেই জানি। তোর জ্ঞানচক্ষু যদি না খোলে আমি কোথায় যাব? কলেজে যাবি তাড়া আছে মানলাম তা বলে তুই কি নিজের ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখবি না? মা বেঁচে আছে তাই এত হেলাফেলা…তাইতো! মা মরলে তুই বুঝবি মা কি জিনিস ছিল!”
একদমে এতগুলো কথা বলে অন্তিকের মা এবার একটু শান্ত হল।
এবার বইয়ের থেকে মুখটা না তুলে পারল না অন্তিক। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আহ! আমার সেমিস্টার চলছে আর তুমি এসব কি কথা বলছ? শেষ পরীক্ষা, আজও তোমায় এসব বলতে হবে! এত সহজেই তুমি চলে যাবে … আর আমরা যেতে দেব নাকি। গেলে আমি তুমি একসাথেই যাব!”
“ধ্যাৎ পাগল! এসব বললে হয়.. আমি তো এক দিন যাবই.. সারাদিন কত চিন্তায় থাকি বলতো! তোর বাবার ওইটুকু নামমাত্র পেনশনে আর কি চলে? কীভাবে যে এই সংসারটা চলছে বুবাই তা আমিই..”
“মা প্লিজ। এমন করছ যেন আমি কিছুই কন্ট্রিবিউট করিনা… আমি একটা বেশ ভাল মাইনের চাকরি করছি সবে। তাছাড়া এতগুলো স্কলারশিপ…”
” থাক হয়েছে! ভালো কথা… তোর বার্লিন ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্ট কবে? জানিস বুবাই তুই যদি বিদেশে যাস, আমি আর তোর বাবা একসঙ্গে প্রতিদিন হইহই করে প্রভাতফেরি করব.. কিন্তু তুই যে বিদেশে পড়বি অত টাকা কোত্থেকে আসবে?”
“মা নো চাপ! এভরি প্রবলেম হ্যাজ ইটস স্কলারশিপ ফর মি।”
কলেজে আসতে আসতে অন্তিকের মাথায় অনেক কিছু কথা ঘুরতে থাকছিল। মা কেন এত মরে যাওয়ার কথা বলে সারাদিন? হ্যাঁ, শরীর বেশ ভালো নেই সিটি স্ক্যান করতে হবে সামনের মাসে…
“এই অন্তিক… গুড মর্নিং! কী এক্সাম রে আজকে তোর?”
কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকতেই অঙ্গনের মুখোমুখি হল অন্তিক। অন্তিক ওকে একদমই সহ্য করতে পারে না। অঙ্গন জ়ুওলজির ছেলে। ছেলে হলেও মেয়েদের মতই স্বভাব। কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়া করা, সব স্টুডেন্টদের সাথে শয়তানি, সব সময় নিজের মতামত জাহির করা, অন্য লোকদের নিয়ে সমালোচনা করা এইসব নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যই ওর নেশা। অন্তিকের সেই ছোটবেলার বন্ধু ছিল সৃজন। সেই ছেলেটাও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ বেইমানি করছে। জগতটাই বেয়াদবে ভরে গেছে।
অঙ্গনকে কোনোভাবে এড়িয়ে ও সোজা পরীক্ষা হলে ঢুকতে যাবে, ওকে প্রচেতা ডাকলো, “শুনবেন, আপনার সাথে একটু দরকার আছে আমার। আসলে আমার একটা সাহায্য দরকার।”
“আরে তুমি! এই প্লিজ আমায় আপনি আজ্ঞে করবে না। ফার্স্ট ইয়ার থেকে ফাইনাল ইয়ার চারটে বছর গেল, এবার তো একটু এই অভ্যেসটা পালটাও। এটা কলেজ বস আমরা সবাই তুই-তোকারি করি। তুমি যদি তুই বলতে আনইজ়ি ফিল করো তাহলে ‘তুমি’ বলো।” কথাগুলো শেষ করে ব্যাগ থেকে বোর্ড, এডমিট কার্ড আর এডমিট কার্ড বের করল অন্তিক।
“আচ্ছা। বলছি যে আমার না কয়েকটা ক্যালকুলাসের সমস্যা হচ্ছে। তোমার নিউমেরিক্যালসে মাথা খুব ভালো। আজ তো শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমার হাতে এক ঘন্টার মতন সময় আছে তুমি একটু লাইব্রেরিতে আসতে পারবে? তাহলে কয়েকটা ডাউট ক্লিয়ার করা যেত একসাথে।”
ওদের মধ্যে খুব একটা কথার আদান-প্রদান হয়নি এই চার বছরে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অবাধ্য ক্যালকুলাসগুলোই ওদের মধ্যেকার সাঁকো। কলেজের লোকমুখে ওরা নাকি ভয়ানক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাও অন্তিক যতবার প্রচেতার সাথে কথা বলে ওর ততোবারই মনে হয় পৃথিবীর কোনও এক হিমবাহ থেকে আবার বরফ গলা শুরু হল।
(ক্রমশ)