[]ছয়[]
“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যেজন ভাসায়…”
মা কতদিন পর গান ধরল। মাকে গান গাইতে দেখলে অন্তিকের মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। বাবা সেই কখন গেছে ডাক্তারের চেম্বারে রিপোর্ট নিয়ে এখনো এলো না।
অন্তিকের মা গান থামিয়ে ওকে ডাকে। অন্তিক কাছে এলে ওর মা বলে, “বুবাই.. কলেজ যাচ্ছিস না কেন দু-তিন দিন ধরে?”
—”বাড়িতে বসেই প্র্যাকটিস করছি। তোমার শরীর ভালো নেই তাছাড়া কী হবে গিয়ে? এখন তো কোন ক্লাস হয় না।”
—”তুই কিন্তু আগের থেকে একটু বেশি পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেছিস। সারাদিন এতো গম্ভীর থাকিস কেন? এইটুকু বয়সের ছেলে কোথায় গান-বাজনা হৈ-হুল্লোড় নিয়ে থাকবি। কোনো মেয়ে ঘটিত ব্যাপার আছে নাকি রে?”
—”না-না তোমার ছেলে ওসব করতে কলেজে যায় না। ফাইনাল সিমেস্টারের কটা দিন বাকি তুমি বলো। এই সময়টা কোর স্টাডি না করলে পরে তো প্রবলেম হবে।”
প্রচেতার বিয়ের কথাটা জানার পর থেকেই অন্তিক নিজেকে কেমন গুটিয়ে রেখেছে। একটা দিক দিয়ে ভালো হয়েছে ওদের প্রোগ্রাম একমাস পিছিয়ে গিয়েছে। তাও অন্তিক রিহার্সালে খুব একটা বেশি যায় না। দু একবার গিয়ে প্রচেতার মুখোমুখি হয়েছিল সেরকম কোনো কথাই বলেনি।
একদিন হঠাৎ প্রচেতা নিজে থেকেই ওকে বলল, “তোমার কি শরীর খারাপ? কারোর সাথে কথা বল না। এখন আরও নিজেকে কেমন গুটিয়ে রাখছ… তোমার বেস্টফ্রেন্ডের সাথেও কোনও কথা বলো না কিছু হয়েছে?”
—”কী হয়েছে সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো, শুধু শুধু জিজ্ঞাসা করছ কেন?”
আনমনে অন্তিক কী সব ভেবে যাচ্ছিল। সম্বিত ফিরল ওর মায়ের কথায়, “আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমি চলে গেলে তুই আর তোর বাবাতে কী করবি?”
—”মা ভালো হবে না বলছি…আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
অন্তিকের বাবা কখন ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে কেয়ার করেনি ওরা। অন্তিকের বাবা একটু গম্ভীর গলায় ওকে বলল, “বুবাই একটু এই ঘরে এসো দরকার আছে।”
অন্তিক ওই ঘরে যেতেই ওর বাবা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “বুবাই তোমার মাকে আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবো না… এত ক্রিটিকাল কন্ডিশনে ও কী করে যে গান ধরল! সানন্দার লাস্ট স্টেজ ব্রেন ক্যান্সার… আর কিছু করা যাবে না ….তাও শেষ চেষ্টা! কালকেই ওকে হসপিটালে এডমিট করতে হবে।”
কথাগুলো শোনার পর অন্তিকের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ওর বাড়িতে সপ্তাহে চার দিন নিরামিষ খাওয়া হয়। ভগবানের জন্য! কী হল এসব করে?… কেমন ভগবান যে মাকে আটকে রাখতে পারবে না।
যে ভয়টা ছোটবেলা থেকে পেয়ে আসত সেটাই আজ হচ্ছে… মাকে ছাড়া কীভাবে জীবন কাটাবে! মা ছাড়া তো পুরো জগৎই অসীম অন্ধকার।

[]সাত[]
আজকে ফেয়ারওয়েল। অন্তিকের মন একদমই এতে নেই। সারাদিন শুধু মায়ের জন্য চিন্তা এই বুঝি কোন খারাপ খবর আসে। মাকে ছাড়া কি করে চলবে অন্তিক ভেবে উঠতে পারছে না। কাল ওর বার্লিন ইউনিভার্সিটি এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফরেন কান্ট্রি লিস্টে সাত নম্বরে নাম। যে মানুষটা বলেছিল প্রভাতফেরী করে বেড়াবে সেই মানুষটাই আর থাকবে না কিছুদিন পর।
—”আমায় ওই দিনের জন্য ক্ষমা করে দিস। কাকিমার যেটা হয়েছে খুব প্যাথেটিক ব্যাপার!”
কথাগুলো বলল পূর্বাশা। সেই দিনের পর থেকে আর কোন বন্ধুর মুখদর্শন করতে চায়না অন্তিক। পূর্বাশাকে ও বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল পূর্বাশা ওর ভগবানকে অপমান করেছে। এর কোনো ক্ষমা নেই। পূর্বাশার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা হয়তো অনুচিত ছিল কিন্তু ভালবাসাটা খাঁটি ছিল।
—”আমি তোমার মায়ের খবরটা পেয়েছি অত্যন্ত বাজে খবর। হাসিখুশি মানুষটা মধ্যে কীভাবে…আজ প্রোগ্রামের পর আমি নিজে মাইকে এনাউন্স করব। যদি কেউ কোন ভাবে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে!”
দু-মাস পর প্রচেতা আবার কথা বলল অন্তিকের সাথে এই মুহূর্তে কথাটা বলা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
—”আর কী হবে! টাকার পর টাকা খসে যাচ্ছে অথচ আমরা সবাই জানি মানুষটাকে আর বাঁচাতে পারব না। তুমি এসবের মধ্যে জড়িও না। আমি তো আর কয়েক মাস পর বিদেশে চলে যাব। তুমি যে আমার জন্য করবে বলছিলে এটাই সারা জীবন থেকে যাবে.. তাছাড়া তো তোমার সামনের মাসেই বিয়ে!”
—”তুমি যদি না চাও বিয়েটা কিন্তু নাও হতে পারে… ভেবে দেখো।”
—”কিছুই হারায় না প্রচেতা…আমরাই শুধু দূরে সরিয়ে রাখি …পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি!”
(ক্রমশ)