মন-চিঠি: শান্তনু ভূঁইয়া
প্রিয় ভারতবর্ষ,
আমি রেজওয়ানা খাতুন,পলাতকা মুসলমান রমণী। আমার দেশ ভারতবর্ষ থেকে বহুদূরে নেপালের জনকপুর থেকে আমার জীবনের গল্প পাঠাচ্ছি।
আমার জন্ম বাংলাদেশ কুমিল্লা জেলার ময়নামতি গ্রামে। বাবা শেখ জলালউদ্দিন ছিলেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। নেতাজির ডাকে সাড়া দিয়ে জমি-বাড়ি সব বিক্রি করে এদেশে এসে সিংহভাগ অর্থসহ নিজে যোগ দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীতে। দু’বছর পর যুদ্ধে একটা পা হারিয়ে ফিরেছিলেন আমাদের নতুন বাসা মুর্শিদাবাদের পলাশপুর গ্রামে। বাবা একজন মৌলবী-শিক্ষক হিসেবে আজীবন শিক্ষাদান ও সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর মা সরকারি অফিসের দোরগোড়ায় বারবার ঘুরেও স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে যেদিন ব্যর্থ হলেন, সদ্য আঠারো ছোঁয়া মেয়েটির সংগ্রাম শুরু হলো সেদিন থেকে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অফিস ক্লার্কটির ঘৃণ্য ইশারা আর ড্রয়ারে বাবার একমাত্র স্মারক পত্রটি লুকিয়ে রাখার চেষ্টার পুরস্কার স্বরূপ সজোরে এক থাপ্পর, আমাকে পোঁছে দিয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ও মায়ের পেনশনের খুব কাছাকাছি।

ইতিহাসে মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটি বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা। আপ্রাণ চেষ্টা ও বাবার শিক্ষা আমাকে স্কুলে খুবই জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তিন বছর পর অন্য একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হয়ে চলে যাওয়ার সময় আমার প্রাপ্তি সন্তানতুল্য ফুলের মত ছাত্র-ছাত্রীদের চোখের জল। নতুন স্কুলটি একটি মাদ্রাসা। নামেই স্কুল, কিছু ছাত্র থাকলেও ছাত্রীর সংখ্যা নেহাত এই নগন্য আর সেখানে ইসলামিক গ্রন্থ আলোচনা ও কিছু মৌলনাসাহেবদের ভাষণ ছাড়া কিছুই হয় না। দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে স্কুলটিকে এক নতুন চেহারা দিতে পেরেছিলাম। বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী জুটিয়ে স্বাভাবিক পড়াশোনা, সর্বধর্ম সমন্বয় ও দেশাত্মবোধক শিক্ষা দেওয়ার অপরাধে চক্ষুশূল হলাম মৌলবাদী অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের। আমি নাকি বিধর্মী, কাফের। ছাত্রীদের বোরখার বাইরে এনে নীতিশিক্ষা দিয়ে পবিত্র কুরআনের অপমান করছি! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি শুধু অন্ধকারে ডুবে থাকা মুসলিম সমাজের আগামী দিনের ছোট ছোট শিশুগুলোকে প্রকৃত শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে চেয়েছিলাম। অনেক অভিভাবকদের কাছেও গৃহীত হয়েছিল আমার ভাবনা। বেশ কিছুদিন চলেছিল অসম লড়াই। মিডিয়া এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশংসিত হয়েছিল আমার চেষ্টা। কিন্তু ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ, একদিন স্কুলফেরত শ-দুয়েক উগ্র মৌলবাদী আক্রমণ করল আমায়। মাথায় একটি লোহার রডের আঘাতে জ্ঞানহারা হয়েছিলাম। সাতদিন পরে আংশিক সুস্থ হয়ে জানলাম কেউ আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, জ্যান্ত পুড়ে মারা গেছেন আমার শয্যাশায়ী আম্মি।
হাসপাতাল থেকে ফিরলে আবার আক্রমন করা হবে এই আশঙ্কায় আমার স্কুলের দারোয়ান সঞ্জয় বাহাদুর তার বাড়িতে নিয়ে এসেছে আমায়।
গত একবছর ভালোই আছি, এক মুসলমানকে আপন করে নিয়েছে আদ্যোপান্ত হিন্দুসমাজ। জনকপুর নাকি রামায়ণের দেবী সীতার জন্মভূমি। মা সীতার মত আমারও অগ্নিপরীক্ষা আপনজনদের হাতে। আমার ছোট গল্প শেষ হয়েও হয়নি। এখানকার একটি স্কুলের দিদিমণি আমি। আবার নতুন কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটানোর স্বপ্ন দেখি আমি। জাতি না ধর্ম-বর্ণ নয়, আমি সুভাষচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, স্যার আব্দুল কালামের মতো ভালো মানুষ তৈরির স্বপ্ন দেখি আজও। আমি ভালো আছি আমার প্রিয় ভারতবর্ষ, তুমিও ভালো থেকো।