মনভ্রম: শান্তনু ভূঁইয়া
সকালে নিজের বাগানে বসেই সকালের “গুড মর্নিং টি”-পর্ব সারছিলেন প্রখ্যাত শিল্পপতি শ্যামল নাগ। সকালে ঘুম থেকে উঠে শখের ছোট বাগানটা নিজের হাতে তদারকি করেন। তারপর বাগানে বসেই সকালে চা খাওয়া, খবরের কাগজে চোখ বোলানো আর গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখে নেওয়া। এই ঘণ্টাখানেক জীবনটা উপভোগ করেন; আর এই রুটিন চলছে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে গত আট বছর ধরে। কলকাতায় অফিস, দুর্গাপুর আর পানাগরের সারের কারখানা, অধঃস্তন কর্মচারীদের নিয়েই সারাদিন কাটে শ্যামলবাবুর।
“কিরে ব্যাটা! আজ যে বড় চুপচাপ? এসে তোর বিখ্যাত কায়দায় গুড মর্নিং পর্যন্ত বলিস নি!” —বলেই মন খোলা হাসি দিয়ে তাকালেন নবারুণের দিকে।
শ্যামল বাবুর ড্রাইভার, পাড়ার বখাটে ছেলে ছিল এই নবারুণ। দু’বছর আগে একটা মেয়ে জুটিয়ে বিয়ে করে ফেলল। শ্যামলবাবু শুনেছেন মেয়েটি নাকি বেশ ভালো ঘরের আর পড়াশুনা জানা। সে এসেই হতভাগাটার জীবনটা খানিকটা বদলে দিয়েছে। বউয়ের উৎসাহেই ড্রাইভিং শিখে কিছুদিন এমএলএ সাহেবের গাড়ি চালাত। সেখান থেকে ছেড়ে শ্যামলবাবুর কাছে। ছেলেটা মনের দিক থেকে বেশ ভালো, বিশ্বাসী আর খুব সাহসী।
— “কি বলবো স্যার? ছেলেটার খুব শরীর খারাপ। আপনার বউমা হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো। বলেছে বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তাই… মানে একটু চাপে আছি।”
জোর করে বিন্দাস ভাবটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে নবারুণ।
—”আরে ঠিক আছে, আমি আছি তো, যা ব্যবস্থা করার আমি করে দেব।” সান্ত্বনা দিলেন শ্যামলবাবু।
—”না স্যার ওসব সাহায্য আমি নেব না। বউ বলেছে কারো কাছে মাথা বিক্রি না-করতে। আচ্ছা স্যার আমার বউটা পড়াশোনা জানে, আপনি কিছু একটা কাজ দিন না। কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” অনুরোধের সুরে বলে নবারুণ।
—”আচ্ছা বেশ, নিয়ে আসিস একদিন তোর বউকে, এখন আমি যাই রেডি হয়ে আসি। আজ দুর্গাপুর যাব।” বলতে বলতে ঘরে গেলেন শ্যামলবাবু।
********★********
—”পারমিতা, অফিস আর ফ্যাক্টরির ফাইলগুলো একটু আলাদা করে রেখো। তুমি আসায় আমার অনেকটা সুবিধা হয়েছে। আজ অনেকটা রাত হয়ে গেছে তুমি নবর সাথে বাড়ি চলে যাও” অফিস থেকে ফিরে প্রিয় চেয়ারটিতে গা-এলিয়ে দিয়ে বললেন শ্যামলবাবু।
নবারুণের অনুরোধে তার বউকে বাড়িতেই বিভিন্ন প্রয়োজনের কাজগুলির দায়িত্ব দিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। মেয়েটি বুদ্ধিমতী, সুন্দরী এবং দায়িত্বশীল। এমন একটি মেয়েকেই খুঁজছিলেন বিপত্নীক মধ্যবয়স্ক একলা মনের শ্যামল বাবু।

“বাবুরে, বউমা আজকাল খুব ব্যস্ত থাকে তোর ওই বাবুকে নিয়ে। আগে দুপুরে বাড়ি ফিরতো এখন আর তাও ফেরে না। মাঝে মাঝে ছেলেটাকেও নিয়ে যায়। রাতেও মাঝে-মাঝে দেরি হয়।” মায়ের এমন অভিযোগ মাঝেমাঝে শুনতে হয় আজকাল। নবারুণ নিজেও যে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি তা নয়। স্যারকেও আজকাল সব কাজে পারমিতাকে খুঁজতে দেখে তার ভাল লাগেনা। পাশে পড়ে থাকা পারমিতা মোবাইলটা একটু নাড়াচাড়া করতে হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ দেখে চোখ আটকে গেল। স্যারের মেসেজ,”আরে তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তো আছি তোমার পাশে। আরে নবারুণ কিছু জানতে পারবে না।” আগে-পরে আর কোন মেসেজ নেই। রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়ার পরে আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে মোবাইলটা ঘাঁটতেই দেখে স্যারের ম্যাসেজ “আজ তোমার রান্না করা পমফ্রেট মাছটা অসাধারণ হয়েছে। সত্যিই তুমি অসাধারণ। হতভাগা নবারুণটার কপাল ভালো। তোমার টাকাটা টেবিলে ড্রয়ারে রাখা ছিল বলতে ভুলে গেছি। কালকে অবশ্যই নিয়ে নিও। গুড নাইট কালকে দেখা হচ্ছে।”
এর আগেও পারমিতার ব্যাগে কয়েকবার অনেকগুলো টাকা দেখে নবারুণ প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু পারমিতা এড়িয়ে গেছে। আজ আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না। এ দ্বিচারিতা কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা নবারুণ। পারমিতাকে প্রচন্ড অপমান, গায়ে হাত তোলা সবশেষে নবারুণ বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। পারমিতাও কথা না-বলে রাতের অন্ধকারে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল অজানা আশ্রয়ের খোঁজে।
দুদিন পারমিতা ও নবারুণকে কাজে আসতে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন শ্যামল বাবু। দুজনের কেউই ফোন ধরছে না, ভারি মুশকিল। নিজেই নবারুণদের বাড়ি এলেন খোঁজ নিতে। দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলো নবারুনের মা, “এভাবে আমাদের সংসারটা শেষ করে দিলেন কেন? বলে ঘরে ঢুকে গেলেন বৃদ্ধা।” সামনে নবারুণ, চোখগুলো রক্তজবার মতো লাল, নেশায় এখনো টলছে। —”আপনার মেয়ের মত ছিল স্যার, আপনি আমার বউকে!! ছি ছি স্যার। আপনাকে ভরসা করেছিলাম।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল নবারুণ।
অপ্রস্তুত শ্যামলবাবু কিছুটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, “পারমিতার সাথে কী করেছিস হারামজাদা?”
—”ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি, শালা নবগুন্ডার সঙ্গে ধোঁকাবাজি!! আপনাকেও ক্যালাতে.. ,আপনি নেহাত বাবার বয়সী তাই, এখন ফুটুন তো। আপনিও শালা আমার সাথে দুনম্বরী করেছেন।”
—”ওরে নব! তুই এ কী বলছিস বাবা? তুই আমার ছেলের মতো, পারমিতা আমার মেয়ের মতো ছিল। আমার তো কোনো সন্তান নেই। পারমিতা আমায় সন্তান দুঃখ ভুলিয়ে ছিল। তুই জানিস তোর ছেলের হার্টে ফুটো? মেয়েটা কোনদিন তোদের কিছু বলেনি। আমাকেও বলতে চায়নি প্রথমে। কিন্তু ছেলেটাকে তো বাঁচাতে হবে। আর আমার তো কেউ নেই, তোদেরকে আপন করে নিয়েছি। আর তুই! এইসব ভেবে নিজে কষ্ট পেলি আর মেয়েটাকে কষ্ট দিলি বাবা? আমাদের সম্পর্কটা কেমন শুনবি? পারমিতা আমার মেয়ের মতো, এই দেখ হতভাগা গত পরশুদিন এই রুমালে সে লিখে দিয়েছে “নতুন বাবাকে – পারমিতা।”
এক মুহুর্তে পাথর হয়ে গেল নবারুণ, পারমিতা প্রতিমুহূর্তে সাথ দিয়েছে, সব সময় বলেছে, “চিন্তা কি, আমি তো আছি।” আর আমি! এমন ঈশ্বরতুল্য স্যারের সম্পর্কে দ্বিচারিতার কথা ভেবেছি? আসলে আমি নিজেই কি দোষী? আমি সম্পর্কের উপর ভরসা রাখতে পারিনি? আমি কি সবার সাথে এমনকি নিজের সাথেই দ্বিচারিতা করে ফেললাম?”
” আরে পা টা ছাড় বাঁদর, যা করার তো করে ফেলেছিস, এবার চল, মেয়েটাকে খুঁজতে যাবি তো? জানিনা বাচ্চাটাকে নিয়ে মা আমার কোথায় ঘুরছে?”
শ্যামলবাবু কাছে টেনে নিলেন নবারুণকে, “বাবা কারো সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার সঙ্গে কথা বলবি। আসলে আমাদের মনটাই দ্বিচারী। আর এই ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল গুনতে হয় সারাটা জীবন।”