ভাস্কর: তনিমা হাজরা
“ও মা কুড়কুড়ি, ঘটিটা একটু এদিকপানে এগিয়ে দে না মা” কাদার তাল মাখতে মাখতে হাঁক দেয় প্রীতিলতা। প্রীতিলতা হচ্ছে কুড়কুড়ির পিসিদিদা, মানে বাবার পিসিমা। বয়েস ষাটের কোঠা ছুঁইছুঁই। এই মফঃস্বল শহরের একমাত্র মহিলা মৃৎশিল্পী সে। বাপদাদার পরে সেই পৈতৃক জীবিকাকে আগলে রেখেছিল কোলের বাছার মতন। যেমন আগলে পাশলে বুকে করে রেখেছিল অকালমৃত বড় ভাইয়ের সন্তানগুলোকে। কৃপা, সদা, বাসি, বদনা। টইটই ছানাগুলোর দিকে তাকিয়ে পনেরো বছরের প্রীতিলতা আর নিজের সংসারের কথা ভাবেনি। বুকের দুধ হলনা তো কী? স্নেহ কী দুধেই কেবল ঝরে?
বাপ নেতাই পাল আর দাদা সনাতন পাল এলাকার নামকরা শিল্পী ছিল। তাদের হাতে গড়া ঠাকুর যেন কথা কইতো। বিদেশেও অর্ডার যেত। দুগগা, কালি, লক্ষ্ণী, রাধাকৃষ্ণ, শিব, শেতলা, কাত্তিক, সরস্বতী, তারা, ঘেঁটু, গণেশ, বড়ঠাকুর সব গড়া হতো তাদের বাখুলে। প্রথম দিকে সব সামাল দিতে না পারলেও প্রীতি হাল ছাড়েনি। আস্তে আস্তে সারাবছরই কিছু না কিছু গড়তো। প্রথম প্রথম কেউই ভালো চোখে দেখেনি। মেয়েমানুষের হাতে গড়া প্রতিমা, নাক সিঁটকেছে, প্রাপ্য দাম দেয়নি। কেউ কেউ আড়াল থেকে অর্ডার ভাঙচি দিয়ে কাঠি করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হাল হারেনি সে।
দাদা চলে যাবার বছর চারেকের মধ্যে বউদিদিও চলে গেল। বুড়ো বাপ আর কচি ছেলেপুলেগুলো নিয়ে চাট্টানের মতো সোজা দাঁড়ালো প্রীতি। যেন দুঃখবিনাশিনী দূর্গতিনাশিনী মা দুগগা।
আর সেই ছেলেটা যে কিনা তাকে খুব ভালোবাসতো, বাঁশবনের ধারে সেই কিশোরীবেলায় তার হাত জাপুটে তাকে বলেছিল, তোকে ছাড়া বাঁচবুনি প্রীতি, সেও বাপমায়ের বাধ্য সেজে বেশ খানিক নগদ নিয়ে টুকটুকে বউ নিয়ে এলো হাসিমগঞ্জের মকুমাশঅর থেকে। বদনাকে ট্যাঁকে করে তার বৌভাতে গিয়ে একটা পিতলের ডেকচি প্রেজেন্টেশন দিয়ে দিব্যি একপেট খেয়ে ঢেকুর তুলে আসবার সময় তাকে বলে এসেছিল সে, মাংসটা বড্ড ভালো খেলাম গো, শুদু মেঠাইটা এট্টু যেন টোকো ঠেকলো গো, ধরণের দিন তো, জষ্টিমাস, আষ্টেপিষ্টে সুখ নিয়ে বেঁচে থাকো বাপু।

পিছু ফিরে আর সে তাকায়নি, সেও তো এখন পাঁচ বাচ্চার বাপ, খেঁকুড়ে, পাকাচুলো।
আশ্বিনের মেঘে যেমন জল ফুরিয়ে যায়, তার কাজ শুধু ভেসে চলা, প্রীতিও যেন তাই, সম্পর্কের দায়ের ডালে ডালে তার হাঁটা।
কৃপা, সদা, বাসি, বদনা টুকুরটুকুর বড় হলো। তার কুমোরবাখুলের পাশে কৃপার দশকর্মা আর শোলার দোকান হল, “প্রীতিলতা সাজঘর “। সদা ঠাকুরের অর্ডার নেওয়া আর টাকাপয়সার হিসাবকিতাবের দিকটা দেখে। ছোট বদনা হাঁড়ি, মালসা, গেলাস, থালা, কলসী সব বানানোর চাকা বসিয়েছে। সেইদিকটা সে দেখে।
বাসি মানে বাসন্তী দাদার মেয়ে। সে আর বৌমারা মানে কৃপা, সদা আর বদনার বউ তার সাথে মূর্তি গড়ার কাজে সাহায্য করে। বাসির এই গ্রামেই বিয়ে দিয়েছে সে। চাষীবাসী ঘর।
কাঠের অবয়বে খোড়ো মেড় বেঁধে মাটির প্রলেপ লাগাতে লাগাতে প্রীতি কেমন যেন গর্ভসুখ পায়। পোয়াতি মেয়ে যেমন তার পেটে টুকুন টুকুন করে শিশু গড়ে ঠিক তেমন দিনে দিনে মূর্তি আকার পায়।
এই যে বারবার মাতৃত্বসুখ এ কথা যে কাকে বোঝাবে?
এই কুড়কুড়িটা কৃপার মেয়ে। ছোট্ট থেকে এমন যমন্যাওটা তার যে কী বলব, হাতে হাতে খড় দিতো, মাটি দিতো, জুলজুল চোখ মেলে রঙ দেওয়া, মুখ আঁকা দেখত অবাক হয়ে।
হেই পাগলি যা ইস্কুল যা দিকিন, না, পিসিদিদি আমি তোর মতো ঠাকুর বানাবো।
বেশ বানাস যেন, তবে পিসিদিদির মতো মুখ্যু ঠাকুর গড়ুনে তোকে হতে দেবোনা আমি, কুড়কুড়িকে আদরে জড়িয়ে বলে প্রীতি।
সেই উদ্দেশ্য ঠান করে ইস্কুলের পড়া শেষ করিয়ে শান্তিনিকেতনের কলাভবনের আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে তাকে। একদিন সে একজন প্রশিক্ষিত ভাস্কর হয়ে উঠবে। দেশে বিদেশে নামডাক ছড়িয়ে যাবে তার। দানা দানা স্বপ্ন মালার মতো ছড়িয়ে থাকে তার ভিতরে।
কাদা মাখতে মাখতে ঘেমে ওঠে প্রীতিলতা। জলের ঘটিটা এগিয়ে দিতে এসে তাদের ঘরের চিন্ময়ী দুগগাটিকে চোখভরে দেখে কুড়কুড়ি ওরফে কলাভবনের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মহিলা ভাস্কর নীলিমা পাল।
কপট ধমক দিয়ে বলে, খালি সকাল থেকে মাটিচাটি ঘাঁটলে হবে? জর্দাখানখানা সেজে এনেছি যে, খাবেটা কে?
প্রীতিলতা মুখখানা বাড়িয়ে হাঁ খুলে বলে, গালে ঠুঁসে দে না বাছা, দেখছিস না হাতভরা কাদা। এবার মূর্তি তুই বানাবি। আমি মাটিটা ভালো করে ঠেসে দিচ্চি কেবল।
এক দুগগা গালে গুয়াপান দিয়ে যেন আরেক দুগগাকে বরণ করে। এক প্রজন্ম থেকে শিল্পের ঢেউ আরেক প্রজন্মের তটে আছড়ে পড়ে। গর্ভজল ছলাৎ ছলাৎ করে বইতে থাকে।
হাতের মমতায় মূর্তি তিল থেকে ক্রমশ তিলোত্তমা হয়ে ওঠেন।
One thought on “ভাস্কর: তনিমা হাজরা”