ভারতে করোনাভাইরাস অতিমারী সংক্রমণের আর্থ-সামাজিক প্রভাব: একটি মূল্যায়ন(১ম পর্ব): – ড: সমীরণ মন্ডল
করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ সম্বন্ধে এখন আমরা অনেকটা না-হোক কিছুটা হলেও জানি। আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা, রোগটির সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়তো বাধ্য হয়েই শুনেছি এবং এই বিষয়ে আমাদের করণীয় কী, সে সম্বন্ধে পুরোটা না-জানলেও অর্ধসত্য তথ্য আমরা জানতে বাধ্য হয়েছি।
কোভিড-১৯ অতিমারী বা মহামারী বিশ্বব্যাপী ১৫০ মিলিয়ন মানুষকে আক্রান্ত করে ফেলেছে ও ৩০ লক্ষের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আরও হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে অতি সংকটের মধ্যে জীবনযাপন করছেন। এটি আসন্ন অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মন্দার আশঙ্কাও জাগিয়ে তুলেছে। সামাজিক দূরত্ব, স্ব-বিচ্ছিন্নতা এবং যাতায়াতের নিষেধাজ্ঞাগুলি সমস্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র জুড়ে কর্মশক্তিকে হ্রাস করেছে এবং অনেকে কাজ হারিয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্র তালাবন্দি এবং পণ্যদ্রব্য ও উৎপাদনজাত দ্রব্যগুলির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে, চিকিৎসা সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর মধ্যেই প্রয়োজনের অধিক পণ্য ক্রয় এবং খাদ্যপণ্য মজুদ করার কারণে খাদ্য খাতেও বাড়তি চাহিদার মুখোমুখি হচ্ছে। এই বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের মধ্যে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব অর্থ-সামাজিক দিকগুলির উপর কোভিড-১৯ এর স্বতন্ত্র প্রভাবগুলির সংক্ষিপ্তসার আপনাদের সামনে তুলে ধরছি ‘নবতরু ই-পত্রিকা’-র মাধ্যমে।
নব্য চিহ্নিত সংক্রামক করোনভাইরাস (সার্স-কোভ-২) ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চিনের উহানে উদ্ভুত হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। উৎস এখনও অস্পষ্ট। কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে এক বড়ো চ্যালেঞ্জ। ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনাভাইরাস-এর দ্রুত বিস্তার সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার কারণে, একটি বিশ্ব মহামারী ঘোষণা করেছে এবং ১১ মার্চ, ২০২০ এই রোগটি অতিমারী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কোভিড-১৯-এর ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলি ইঙ্গিত দেয় যে হাসপাতালে ভর্তি প্রায় সকল রোগীর শ্বাসজনিত এবং সংকটপূর্ণ অবস্থায় নিউমোনিয়া জাতীয় লক্ষণ। কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রাথমিক ইঙ্গিতটি হলো কাশি, জ্বর ও শ্বাস-প্রশ্বাস এর সমস্যা এবং পরবর্তী পর্যায়ে এটি কিডনির ক্ষতি, নিউমোনিয়া এবং অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
সব দেশই বর্তমানে প্রচুর সংখ্যক কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক’রে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়ে শারীরিক দূরত্ব নীতি বজায় রেখে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করছে। ভ্রমণের সীমাবদ্ধতা প্রাথমিকভাবে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

যে দেশগুলি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি গঠন করে, তাদের একটি আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট এবং মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির ডামাডোল বোঝার জন্য আমরা বিশ্ব অর্থনীতির স্বতন্ত্র দিকগুলির উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাবের সংক্ষিপ্তসার এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই নিবন্ধে, আমরা ভারতে ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাস অতিমারীর আর্থ-সামাজিক প্রভাবগুলি আলোচনা ও ভারতীয় অর্থনীতি এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে ক্ষতি হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছি। অর্থনৈতিক প্রভাবকে তুলে ধরার জন্য ভারতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রকে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও সার্ভিস সেক্টর-এ বিভক্ত করে একটি সম্যক ধারণা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক প্রভাবগুলিও আলোচনা করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর লাগামছাড়া বিস্তার জনস্বাস্থ্য পরিষেবাকে মারাত্মকভাবে ধাক্কা দিয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, শ্রমিকদের স্থানান্তরণ, কর্মহীনতা, শিল্প ও কলকারখানা বন্ধ, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড, IMF)-এর মতে, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ৩% এর বেশি হ্রাস পেয়েছে। শুরুতে, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি সরাসরি আর্থিক এবং মূলধন বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। দেশগুলি অতিমারী বৃদ্ধির উপর নজরদারি করার জন্য মানব চলাচল এবং পরিবহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে, যা গ্রাহক এবং উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ উভয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল এ পর্যন্ত কোনও দেশই এর চাপ থেকে রেহাই পায়নি। ভারত এক মারাত্মক আর্থ-সামাজিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। আরবিআইয়ের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন সম্প্রতি বলেছেন “এটি স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় অর্থনীতির সবচেয়ে বড় জরুরি অবস্থা।”
এই সংক্ষিপ্ত লেখনীতে আমি বিশেষত ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
ভারতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর প্রভাব (Sectoral Impacts)
প্রাইমারি সেক্টর (Primary Sector)
কৃষিক্ষেত্র এবং তার সাথে জড়িত ক্ষেত্র (Agriculture & Allied Sector)
অন্যান্য দেশগুলির মতোই করোনা ভাইরাস-এর বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ভারত গতবছর অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ মাসে একটি সম্পূর্ণ লকডাউন করে যা মূলত উত্তর-পশ্চিম ভারতের রবি ফসলের মরশুম ছিল, ফলে কৃষকদের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছিল। লকডাউন চলাকালীন কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিথিলতা থাকলেও পরিবহন-বাধা, মানুষের চলাফেরার সীমাবদ্ধতা ও শ্রমিকের অপ্রতুলতা বিশেষত শ্রমিকদের নিজ রাজ্যে ফেরার কারণে কৃষকরা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। মহারাষ্ট্রের কৃষকরা এটিকে ২০১৬ সালের মুদ্রারহিতকরণ (Demonetization) সময় যে পরিস্থিতি হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বলে উল্লেখ করেছে। এই অতিমারীর আগে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ করে গ্রামীণ মজুরি (প্রকৃত) হ্রাসের পাশাপাশি নৈমিত্তিক শ্রমিকদের আয়ের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খাদ্যের দাম বাড়তে শুরু করলে আশার কিরণ দেখা গিয়েছিল যা এই নতুন অতিমারী সংকটে পড়ে। কৃষিক্ষেত্র এবং তার সাথে জড়িত ক্রিয়াকলাপগুলি একজাতীয় নয়, প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের উপর এর গতিশীলতা নির্ভর করে, যেমন ফসল, প্রাণী-মৎস্য সম্পদ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিমারীর প্রভাব বিভিন্ন। উদ্যান ভিত্তিক কৃষি (Horticulture) ও খাদ্যশস্য (Food grains) উৎপাদন বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। উদ্যান ভিত্তিক কৃষি অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারণ উৎপাদিত ফুল, ফল ও সবজি তাড়াতাড়ি নষ্ট ও পচনশীল হয়। খরিফ ফসলের জন্য ভারত সরকারের পক্ষে এমএসপি (MSP; Minimum Support Price) বৃদ্ধির ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয়ের উপর ৫০-৮৩% ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। লকডাউন-এর ফলে ফল ও সবজির ক্রমহ্রাসমান চাহিদা এবং রফতানি হ্রাস পাওয়ায় উদ্যান ভিত্তিক কৃষিক্ষেত্র অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে, ধর্মীয় স্থানগুলি বন্ধ ও বিভিন্ন বৈবাহিক অনুষ্ঠান স্থগিত থাকায় চাহিদা কম হওয়ার কারণে ফুলের চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রাণিসম্পদে (দুধ, মাংস, ডিম), দুধই প্রধান অবদানকারী যা প্রভাবিত হয়েছে এবং সৌভাগ্যক্রমে, লকডাউনের সময় এই ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। মৎস্য ও জলজ চাষের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।