ভক্ষকই রক্ষক: কৌশিক কারক
“হ্যালো, হ্যালো। ডাক্তারবাবু…আমি সমীর বলছি, শুনতে পাচ্ছেন ডাক্তারবাবু?”
—“সমীর? এত রাতে হঠাৎ কী ব্যাপার? আজ তো মাল ডেলিভারি দিতে যাবার কথা ছিল?”
—“ডাক্তারবাবু, পুলিশ আমার পেছনে লেগেছে। আজ মাল ডেলিভারির সময় ওখানে পুলিশ আসে। জানিনা কী করে ওদের সন্দেহ হয়। আমি ওখান থেকে পালিয়েছি, কিন্তু আমার পায়ে গুলি লেগেছে ডাক্তারবাবু।”
—”কী! পুলিশ! পুলিশ কী করে জানল? আর মালের কী হল?”
—”সে আমি জানিনা। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন, আমাকে বাঁচান।”
—”ঠিক আছে। ঠিক আছে। তুমি চিন্তা ক’রো না। আমি আসছি।”
********
হাসপাতালের সামনে যখন ডা. অনিমেষ পালের গাড়িটা এসে থামল তখন রাত প্রায় দুটো।
—”ভোলা, সমীর এসেছে?”

—“হ্যাঁ স্যার এসেছে। ওই পেছনের স্টোররুমে লুকিয়ে আছে।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে, ওকে তুমি সাবধানে ও.টি.তে নিয়ে এসো। আর সিস্টার পৃথাকে খবর দাও।”
গাড়িটা পার্ক করে ভেতরে ঢুকতেই ফোনটা বেজে উঠল ।
—”হ্যালো। ডা. অনিমেষ পাল বলছি…”
**************
হাসপাতালের ও.টি.তে শুয়েছিল সমীর।
—“আমাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু। পা-টা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার।”
—“আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই সমীর। সিস্টার, জেনারেল অ্যানাসস্থিসিয়া দিতে হবে। না হলে অপারেশন করা যাবে না।”
—“প্লিজ ডাক্তারবাবু—আর পারছি না আমি…”
ধীরে ধীরে চোখ বুজে এলো সমীরের।
**************
(মাসখানেক পর)
নিজের বাড়িতে বিছানায় শুয়েছিল সমীর। আজ দিন-সাতেক হল বাড়ি ফিরেছে ও। সেদিন ডাক্তারবাবু না থাকলে আজ বেঁচে থাকত না। যদিও সেদিন ডাক্তারবাবুর কাজ করতে গিয়েই প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল। মালটা ফেলে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু কপালের জোরে বেঁচে যায়। পুলিশের গুলি পায়ে লাগলেও সেদিন ওর মুখ দেখতে পায়নি পুলিশ। দেখতে পেলে আজ ও আর ডাক্তারবাবু দুজনের কেউই নিজের বাড়িতে থাকতে পারত না। আর পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও ডাক্তারবাবুকেই এসে ওকে বাঁচাতেই হতো। না-হলে ওর পরিবার আজ পথে ভেসে যেত। সেদিন ওর পা-টা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। আর কোনো কাজ করার মতো ক্ষমতা ছিল না ওর। কিন্তু ডাক্তারবাবু ওকে ভুলে যাননি। ওর জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন একটা আধুনিক হুইলচেয়ার আর নগদ পঁচিশ লাখ টাকা। ওই টাকা দিয়েই তো বাজারে দোকান দিয়েছে ওর বাবা। আর বউকে খুলে দিয়েছে পার্লার। সেদিন মালটা ডেলিভারি দিতে না-পারার জন্য কিছুই বলেননি ওকে ডাক্তারবাবু। মনে মনে অন্যান্য দিনের মতো আবার তাকে ধন্যবাদ জানায় সমীর। সারাজীবন নিজের মুখ বন্ধ রেখে ডাক্তারবাবুর উপকারের প্রতিদান দিয়ে যাবে ও।
****************
হাসপাতালে নিজে চেম্বারে বসেছিলেন সার্জন অনিমেষ পাল। আজ সেদিনের ডেলিভারিটার জন্য ফুল পেমেন্ট পেয়েছেন। সমীরকে এবারে বেশি দিতে হয়েছে, কিন্তু তাতে চিরকালের জন্য ওর মুখটাও বন্ধ করা গেছে। এবার ভোলা আর পৃথাকেও ওদের ভাগটা দিয়ে দিতে হবে। সেদিনের ঘটনাগুলো আবার মনে পড়ে গেল তাঁর।
বনোয়ারীলালবাবুর জন্য কিডনি সাপ্লাই দিতে গিয়ে সমীর যদি সেদিন ধরা পড়ে যেত তাহলে আজ তাকেও হয়তো হাজতে থাকতে হত। ভাগ্যিস সেদিন পুলিশ সমীরকে চিনতে পারেনি। সেদিন হাসপাতালে ঢোকার সময়ই ফোন এসেছিলো বনোয়ারীলালবাবুর ছেলের। বাবার কিডনির জন্য তিন কোটি অফার করেছিলেন। এর আগে বিলে কারচুপির মতো ছোটোখাটো কাজ করলেও কিডনি পাচারের মতো বড়ো কাজের বরাত সেটাই ছিল প্রথম। এক কোটি অ্যাডভান্সও নিয়েছিলেন। তাই মাল ডেলিভারি না-হলে তিনিও যে বাঁচতেন না সেটা বলাই বাহুল্য। আর বেঁচে গেলেও বদনামের তকমা জুটত নিশ্চয়ই। তাই ও.টি.তে ঢোকার আগেই কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিলেন তিনি। প্রয়োজন না-থাকলেও কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন সমীরের পা। আর সাথে বার করে নিয়েছিলেন ওর কিডনি। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে জানতেন কিডনি ম্যাচ করবে। জেনারেল অ্যানাসস্থিসিয়া তো ওই জন্যই দেওয়া। তারপর যথাসময়ে ভোলার হাত দিয়ে হয়েছিলো ডেলিভারি। আর সমীরকেও সার্জারির চিহ্ন না যাওয়া অব্ধি রেখে দিয়েছিলেন হাসপাতালে। পঙ্গু সমীরের একটা কিডনিতেই জীবন চলে যাবে। আর অ্যাডভান্সের টাকা থেকেই ওকে পঁচিশ লাখ দিয়েছিলেন। সেইজন্য আজ ওর কাছে তিনি ভগবান। কিন্তু আজ সমীরের জন্যই তার ব্যাবসার সফলতার শুরু। তাই আজ ওর পরিবারকে রক্ষা করেছেন তিনি।
—“ঠিকই আছে।”
মনে মনে ভাবলেন ডা. পাল, “কথায় তো আছেই রক্ষকই ভক্ষক। আবার উল্টোটাকেও তো সত্যি করেছি আমি। ভক্ষকই হয়েছে রক্ষক।”
ভাল গল্প পড়লাম।