কোভিড-১৯ অতিমারি বা মহামারি সারা বিশ্বে অতি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশ্বব্যাপী ২০ কোটির বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন এবং ৪৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির ক্ষতিসাধন এবং রোগের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে একটি সরাসরি সংযোগ রয়েছে-যা ভবিষ্যতের অতিমারি বা মহামারি প্রতিরোধ ও প্রকৃতি রক্ষা এবং পুনরুদ্ধারের ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদেরকে ওয়াকিবহাল করবে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, মানুষ পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের তিন-চতুর্থাংশ-এর বেশি পরিবর্তন করেছে এবং বর্তমানে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ভূমি ফসল বা গবাদি পশু উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করে। নিউ ইয়র্ক ডিক্লারেশন অন ফরেস্টস (NYDF)-এর মূল্যায়ন অনুযায়ী প্রাকৃতিক বন, জলাভূমি এবং অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের এলাকার গুণমান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০১৮ সালে, যুক্তরাজ্যের যা আয়তন তার বেশি বনভূমি বিশ্বব্যাপী ধ্বংস করা হয়েছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD) এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট-এ বলা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯৭০ কোটি, ফলস্বরূপ, খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি এবং জৈব শক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদা ভূমি-ব্যবহারের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন অতিমারি বা মহামারির ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে।
কোভিড-১৯ রোগের বিস্তারের সঙ্গে প্রকৃতির কী সম্পর্ক ?
প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্র মানবদেহের মতোই কাজ করে। সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থায় বিভিন্ন প্রজাতি ও জনজীবনের পক্ষে হিতকর। জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের বিভিন্ন সংক্রামক রোগ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানবদেহের সমস্ত সংক্রামিত রোগের প্রায় ৬০ শতাংশ অন্যান্য প্রাণী প্রজাতি থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত রোগ (জুনোটিক রোগ, Zoonotic diseases)। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ ছাড়াও, পূর্ববর্তী ইবোলা, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, সার্স-১, মার্স এবং হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জীববৈচিত্র্যের উপর মানুষের হস্তক্ষেপ সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শিল্প ও কৃষির সম্প্রসারণ, পরিকাঠামো উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, খনন এবং আরও আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকলাপের ফলে ভূমির ব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় যা বন ও বন্যপ্রাণীর উপর প্রভাব ফেলে। গাছপালা বন-জঙ্গল হ্রাস পাওয়া বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলকে হ্রাস বা ধ্বংস করে যা সংক্রামক রোগের উত্থানের সবচেয়ে বড় একটি কারণ, যা সাম্প্রতিক সংক্রমিত রোগগুলির প্রায় এক তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী। মানুষের জীবিকা, বিনোদন, ওষুধ এবং অলঙ্কারের জন্য বন্যপ্রাণীর উপর নৃশংসতা (বন্দি করা, শিকার, চোরাচালান এবং বাণিজ্য) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করছেন যে সার্স-২ করোনাভাইরাস যা কোভিড-১৯ রোগের অন্যতম কারণ, বাদুড় থেকে উদ্ভূত হয়ে চীনের উহানের একটি সী-ফুড পাইকারি বাজারে পাওয়া মধ্যস্থতাকারী প্রাণী (সম্ভবত প্যাঙ্গোলিনের একটি প্রজাতি)-এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। ২০০৩ সালে সার্স-১ এর আবির্ভাব একই ভাবে সিভেট বিড়ালের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। ভূমির ব্যবহারের পরিবর্তন এবং বন্যপ্রাণীর উপর মানুষের অত্যাচার, মানুষ এবং গৃহপালিত পশুকে রোগজীবাণু বহনকারী বন্যপ্রাণীর সান্নিধ্যে নিয়ে আসে যা পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। বাস্তুতন্ত্রের উপর মানুষের প্রভাব প্রজাতির গঠন, কাজ এবং বাস্তুতন্ত্রের কাঠামোকে ব্যাহত করে ফলে সংক্রামক রোগের গতিশীলতা পরিবর্তিত হয়। বন্যপ্রাণীর উপর নৃশংসতা ও তাদের আবাস্থলের ক্ষতির আশঙ্কা বন্যপ্রাণী প্রজাতির রোগের উৎস এবং নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রকৃতির ধ্বংস ত্বরান্বিত হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রাণীবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঘন ঘন হওয়ার সম্ভাবনা।

কোভিড-১৯ কীভাবে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করছে ?
আমাদের একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে কোভিড-১৯ অতিমারির সময় প্রকৃতি মানুষের কাছ থেকে “বিরতি” পাচ্ছে। পরিবর্তে, অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে জমি দখল, বন উজাড়, অবৈধ খনন এবং বন্যপ্রাণী চোরাচালানের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যারা শহরে তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছেন তারা তাদের গ্রামীণ বাড়িতে ফিরে এসেছেন বা যাচ্ছেন, যা বিপরীতে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ আরও বাড়িয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
এদিকে, এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকায় বন উজাড় হওয়ার খবর সম্প্রতি পাওয়া গেছে। অবৈধ খনি খননকারী এবং বনসম্পদ ধ্বংসকারীরা আদিবাসী অঞ্চলগুলি দখল করছে, যা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিকে ভাইরাসের সংস্পর্শে আনতে পারে। যেসব এলাকা অর্থনৈতিকভাবে পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল তাদের সম্পদ হ্রাস পেয়েছে কারণ পর্যটন বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে আফ্রিকায় বুনো মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এদিকে, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় সোনা ও মূল্যবান পাথরের অবৈধ খনন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে ?
জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, জলবায়ু সংকট নির্দিষ্ট রোগের বিস্তার এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। মরশুম এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন অনেকাংশে যেকোনো ভাইরাস যেমন ফ্লু- ভাইরাস এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও বিজ্ঞানীরা বর্তমানে অনিশ্চিত যে কীভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে প্রভাবিত করেছে বা করছে। গবেষকদের ধারণা যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ভবিষ্যতের রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়, বিস্তার এবং তীব্রতা বা সংক্রমতা নির্ধারণ করবে। কোভিড-১৯ ই জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যুক্ত একমাত্র সংক্রামক রোগ নয়। পরিবর্তিত পরিবেশগত পরিস্থিতি এবং মহামারির মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে বহু বছর ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সতর্ক করে আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই-অক্সাইড-এর পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে যা গাছের বৃদ্ধির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অতএব, জলবায়ুর পরিবর্তন একটি বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে বসবাসকারী প্রজাতির প্রাকৃতিক বাসস্থান-এর উপর প্রভাব ফেলতে পারে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে যে জলবায়ুর পরিবর্তন সরাসরি অনেক বাদুড় প্রজাতির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে, যা নতুন সার্স-২ করোনাভাইরাসের উত্থানের জন্য দায়ী। বন্যপ্রাণী বাণিজ্য সার্স-২ করোনাভাইরাসের মতো জুনোটিক রোগের বিস্তারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের কারণে মানুষ বিভিন্ন প্রজাতির সংস্পর্শে আসে ও সংক্রামিত হয়।
আমাদের কী করণীয় ?
মানুষের স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা আমাদের সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত-প্রকৃতির সংরক্ষণ করা আদপেই আমাদের নিজেদেরকে বাঁচানো। রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার প্রতি’ তে লিখছেন- “দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর”। উদ্ভূত ভাইরাস এবং রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই তিনটি অপরিহার্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত:
১) প্রকৃতি সংরক্ষণ:-
প্রকৃতির সাথে মানবতার সম্পর্ক নিবিড়। বাস্তুতন্ত্র স্ব-নিয়ন্ত্রক, যার অর্থ প্রাকৃতিক ভাবেই প্রজাতি এবং রোগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে, যাকে বিনষ্ট করলে আমাদেরই ক্ষতি। তাই আমাদের উচিত বন্যপ্রাণীদের তাদের প্রাকৃতিক ভাবে বাঁচতে দেওয়া এবং সেই আবাসস্থলগুলির ধ্বংস রোধ করা।
২) বন উজাড় করা বন্ধ করা:-
ভূমি-ব্যবহার-এর পরিবর্তন পশু থেকে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য প্রধানত দায়ী। গাছপালা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা প্রকৃতিতে ভাইরাসের উপস্থিতি দূর করে না; বরং, এটি রোগের বিস্তারকে উৎসাহিত করে। স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র ভাইরাসকে মানুষের মধ্যে তাদের স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে।
অবৈধ বন্যপ্রাণী চোরাচালান বন্ধ করা
অবৈধ ভাবে জীবন্ত পশুপাখি ধরা এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিবহনের জন্য রোগজীবাণু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। বিকল্প জীবিকা তৈরির মাধ্যমে আমাদের অবশ্যই এই অবৈধ বন্যপ্রাণী চোরাচালান বন্ধ করতে হবে।
৩) নীতি প্রণয়ন:-
সরকারকে অবশ্যই প্রথমে বন ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে যা প্রাকৃতিক জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। মানুষের জীবিকার উৎস বলে যাতে মানুষ বন ও বন্যপ্রাণীকে ধ্বংস না-করতে পারে তার জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানুষের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে।

জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং বন উজাড়-যে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাবের দুটি উল্লেখযোগ্য কারণ। যেসব দেশে বন উজাড়, বেআইনি খনন এবং চোরা শিকার বাড়ছে তাদের সরকারগুলিকে জরুরিকালীন ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এমনকি কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ও। দেশগুলিকে অবশ্যই তাদের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠনের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে যাতে জনসাধারণের ব্যয় এবং মূল্য সংস্কারের মধ্যে সমতা বজায় থাকে। বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের পর, সরকার এবং উন্নত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে এমনভাবে যা সামগ্রিক চাহিদা উদ্দীপিত করে এবং কিছু প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির কারণ হয়। এই প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, এবং শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধি করে। বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে যেখানে কার্বন নিঃসরণ অনেক কম হয়। এই ধরনের বিনিয়োগ জীববৈচিত্র্যের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং জীব-বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি হ্রাস করবে, যা বর্তমান অতিমারির একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ফলে এটা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্য-এর ভারসাম্য বজায় রেখে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো রূপায়ণ করা। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বিনিয়োগ যা অতিমারি বা মহামারি প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে, তা অতিমারি বা মহামারির মোকাবিলা করার বিনিয়োগের তুলনায় অনেক কম। কোভিড-১৯ অতিমারির এই সময় প্রকাশিত একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে যে, বন উজাড় বন্ধ করা, বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য ও চোরাচালান বন্ধ করা, চীনে বন্য মাংসের ব্যবসা বন্ধ করা এবং বন্য ও গৃহপালিত পশুর রোগের সঠিক তত্ত্বাবধান-এর মতো পদক্ষেপের জন্য প্রতি বছর ২৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার টানা দশ বছর ধরে ব্যয় করলে কোভিড-১৯ অতিমারির মতো পরবর্তী যেকোনো ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
2 thoughts on “প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও কোভিড-১৯ অতিমারি: ড: সমীরণ মন্ডল”