পুষ্পদীপের আলোকমালায়: লাবণ্য কান্তা
তখন গোধূলিবেলা, ধীরে মিশে যাচ্ছিল বারাণাসীর গঙ্গার জলে অস্তরবির কিরণজ্যোতি; আমরা ছিলাম দাঁড়িয়ে গঙ্গাতীরে কেদার ঘাটে। তখন বসন্ত ঋতু, বাংলাদেশের মতন বসন্তবিলাস আর অন্য কোথাও নেই সে কথা জানা সত্ত্বেও আমি ঢাকায় ছিলাম না—
তাই ঢাকার বসন্ত উৎসবের সাজ সাজ রব
তখন আমাকে খুব উদাসী করেছিল।
সশরীরে তখন ছিলাম বারাণাসীতে,
কিন্তু মনটা পড়েছিলো
ঢাকার বসন্ত উৎসবে …
গঙ্গার জলে কতরকম পাখির ভিড়ে নদীর জলে ছায়া পড়ছিলো, অদ্ভূত এক সৌন্দর্য তখন বিরাজমান সেখানে। এপারে হাজার মানুষের পদধ্বনিতে মুখরিত গোধূলি লগ্ন; আর ওপারে ধবধবে সাদা বালুকারাশিতে যেন দিগন্ত তার নীরবতার চাদরে মুড়ে দিয়েছে—

মাঝখান দিয়ে প্রবাহিতা গঙ্গা ঢেউয়ের পরে ঢেউ ভেঙে
পুষ্পদীপের আলোকমালায়
ঝলমল নীরব সঙ্গীতের হাসিখেলায় কোন অজানায় অবিরাম বয়ে চলেছে।
মনে আমার আপন দেশের বাসন্তী বিকেল
থেকে দূরে থাকার চঞ্চলতা; তবুও
বলতে হয়েছে নিজেকে সত্যি এমন সুন্দর
পুষ্পদীপ কখনো দেখিনি।
গোধূলি মিলিয়ে গেছে গঙ্গার বুকে আবীররাঙা আকাশ থমকে রয়েছে ওপারে, এপারে ধুম লেগেছে সন্ধ্যারতির আয়োজনে। দেশি মানুষের কৌতূহল কিঞ্চিৎ কিন্তু বিদেশি অর্থাৎ ইউরোপীয়ান পর্যটকের ভিড়ে তখন গঙ্গার তীর গমকে উঠেছে; কী যে কৌতূহলী চক্ষু তাদের নিজের চোখে না দেখলে সেসবের বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। ভাবছিলাম—আচ্ছা এই যে এত বিস্মিত চোখ তাদের! এই যে এতদূর থেকে এসে গঙ্গার ঘাটে বসে গঙ্গা আরতি দেখছে বিপুল বিস্ময়ে … এসবের কী বোঝে তারা? ভারতবর্ষ ছেড়ে যাবার সময় বুঝি এসব পিছুটান সঙ্গে করেই নিয়ে গেছে তারা, এমন কিছু ভাবনা এসে আমাকে অন্যমনস্ক করেছে বটে! পেছনের ইতিহাস, ঔপনিবেশিক কালের মিলিয়ে যাওয়া রেখা জ্বলজ্বল করছিল মনের ঘরে, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে আপন মহিমায়—
নদীর জলে শুধু পুষ্পদীপ ভেসে চলেছে স্রোতের টানে
নদীর বুকে আঁধার নেমেছে
পুষ্পদীপেরা আলো বিলোচ্ছে; এমন আশ্চর্য আলো
এমন পুষ্পদীপ আমি
আগে কখনো দেখিনি।
গেরুয়া উত্তরীয় পরে তপস্বীগণ
দেবী আহ্বানে ব্যস্ত
বাঁশিতে বাজছে পঞ্চম সুর পুষ্পদীপের আলোতে আলোকিত নদীর কূল।