পরিত্যক্ত বিভীষিকা (২য় পর্ব) – দীপ্তেশ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন ।
দেখলাম ভাগীরথীর পার ঘেঁষে পরিত্যক্ত একটি পাকা বাড়ি দাঁড়িয়ে। সামনে একটি আমড়া গাছ। কিছু আমড়া ইতস্তত পড়ে রয়েছে নিচে। অনতিদূরে সরষের ক্ষেত মৃদু জ্যোৎস্নায় অস্পষ্ট। দূরে ভেসে আসছে সেই মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি। অনিমেষের আপত্তি উড়িয়ে বেশ উৎসাহ নিয়ে প্রবেশ করলাম সেই বাড়িতে। প্রকৃতি যেহেতু শূন্যতা রাখেনা তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই কিছু আগাছা গজিয়ে উঠেছে বাড়ির প্রাঙ্গণে। নিতান্তই সাধারণ বাড়ি। দেখলাম বাড়ির দেওয়ালে কালো ছোপ সেখান থেকে কিছু দেবদেবীর ছবি ঝুলছে সেখানেও পুরু ধুলো জমে উঠেছে। দরজাগুলো ক্ষয়ে গেছে আর তালায় মরচে পড়েছে। তুলসী মন্দিরে বহুদিনের অব্যবহারে জীর্ণকায়তার নিদর্শন। চারপাশটা ক্রমেই নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কোন এক রহস্যপুরীর রহস্য ভেদের জন্যই এখানে আমাদের আগমন। অন্ধকারটা যেন গাঢ় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। নিকষ কালো বিভীষিকা যেন কালের এক পরিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে কোনও এক অজানা কারণে। চাইলেও সেই স্থান পরিত্যাগ করতে পারছি না। কেউ যেন চারিদিকে অদৃশ্য এক বন্ধনী দিয়ে দিয়েছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে জানান দিচ্ছে চারপাশে কোন এক অশরীরীর উপস্থিতি। সবমিলিয়ে যেন এক ইতিহাসের সাক্ষী এই জায়গা কিছু বলতে চায়, জানাতে চায় অতীতের কিছু স্মৃতিগাঁথা। তার কায়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে বহুদিন পর কোনও মানুষের সংস্পর্শে। ভাগীরথীর ওপার থেকে তারস্বরে শিয়ালের কন্ঠস্বর সেই পরিবেশকে কেমন ভয়াবহ করে তুলল। এদিকে অনিমেষ ব্যাকুল হয়ে উঠল, “তুই শিগগির বাড়ি চল, বাবা মা চিন্তা করবে, আর এক মুহূর্ত না এখানে৷”

আমি কিছু বলে ওঠার আগেই দেখলাম বাড়ির পশ্চিমের শেষ ঘরটার দরজা হঠাৎ খুলে গেল। আর সেই ঘর থেকে অগ্নি স্ফূলিঙ্গ বেরিয়ে আসছে। চারপাশের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। হতভম্ব আমি চিৎকার করে উঠলাম
-“আগুন! আগুন! আগুন!”
অনিমেষ ভয়ার্ত কণ্ঠে তারস্বরে বলল
-“পালিয়ে আয় …….অভি, তাড়াতাড়ি….।”
তারপর হাড় হিম করা সে এক হৃদয়বিদারক কিছু কণ্ঠ নিশীথের নিস্তব্ধতাকে খণ্ড খণ্ড করে দিলো। কারা যেন আকুল ভাবে বাঁচার শেষ চেষ্টা করছে। আঃ……. সে যেন সহ্য হয়না। তারপর সব নিশ্চুপ। আমরা তখন বেশ কিছুটা দৌড়ে এগিয়ে গেছি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে কী বলব বা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এক বিষাক্ত বিষণ্ণতা চারপাশের পরিবেশকে যেন পাল্টে দিলো এক নিমেষে। নিস্তব্ধতা ভাঙলো অনিমেষ। তার চোখে জল। ভাঙা ভাঙা গলায় সে বলল, “আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে আজকের দিনেই এই বাড়িতে আগুন লেগে যায়। ভষ্মীভূত হয়ে মারা যায় এই বাড়ির মানুষগুলো।”
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। রাত্রের ঠান্ডা হিমেল হাওয়া কান্নার কলরবে ভারী হয়ে উঠল।
এও কি সম্ভব? মুহূর্তে দৌড়ালাম সেই পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। দেখলাম সব শান্ত, কোথাও কিছু নেই। পুজো শেষে শঙ্খধ্বনি হচ্ছে তখন দূরে।
তবে একটু আগেই যে করুণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখলাম সেটা তবে কি? সত্যিই কি দেখলাম ?
জানি না আমি। বাড়ি ফিরে আর কিছু বললাম না। পরের দিন বাড়ি ফেরার সময় বিকালের মৃদু আলোয় মায়াময় লাগছিল বাড়িটা। চারিদিকে আগাছার জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে গা-ছমছম করে উঠল।
আজ কেটে গেছে অনেক দিন। কিন্তুু এতদিন পরও আমার বুদ্ধিতে কোনও দিশা পাইনি সেই ঘটনার। হীরামাটির সেই শীতের সন্ধের কথা মনে এলে আজও শিহরন খেলে যায়। সত্যিই কি মনের ভুল ছিল? কী জানি, আজও সেই উত্তর অধরা। বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলেনা।
দুটো পর্ব ই পড়লাম। প্রথম পর্ব পড়ার পর হঠাৎ করে শেষ হয়ে যাবার জন্য বিরক্তি বোধ হচ্ছিল। এখন দ্বিতীয় পর্ব পড়ার পর মনটা অল্প শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মন ভরানো গেলোনা।
মনে হচ্ছে এইমাত্র, আর কিছু নয়?
অভিনন্দন লেখককে।
।
আর একটু বড় হলে আরও খুশি হতাম।। তবে দারুণ লাগলো।