—”কি হবে গো ছায়াদি? বাড়িটা কি সত্যিই ভেঙে ফেলবে?
রমলার ভাঙচোরা মুখে আজ কাজ হারানোর আতঙ্ক।
সে প্রায় অনেকদিন আগের কথা। নতুনগ্রামের এক দরিদ্র চাষির মেয়ে রমলা। নিতান্তই সাদামাটা ছিল ওদের জীবন। বসন্তটা খুব লোভ দেখিয়েছিল। তারপর পেটে এল কুমারী জীবনের অভিশাপ। প্রতিবেশী মহিলারা বলল, “ছিঃছিঃ! আইবুড়ি মেয়ে, তার পেটে…?”
ও পাপটাকে ধুয়ে ফেলতে স্মরণ নিল কাত্যায়নীর। ও অনেক ওষুধের সুলুকসন্ধান জানে। কিন্তু পাপমুক্তির পরেও অপমান থেকে রেহাই মিলল না। একদিন বাপটাও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলে নষ্টা মেয়ের মরাই ভালো।
কাত্যায়নী বললে, “মেয়েছেলের গতর থাকতে ভাবনা কিসের? কিন্তু তোর গাঁয়ে থাকা চলবেনি। বদ্দমানে যেয়ে কাজ করতে হবে। তোর রূপ আছে, যইবন আছে। তোর আবার ভয় কিসের?”
প্রথম প্রথম বড্ড ভয় করত। তারপর একসময় সে দক্ষ দেহপসারিনী হয়ে উঠল। অনেক টাকা, অনেক সুখ। একদিন দেহ ভাঙল, টাকাও কমে আসতে লাগল।
মহজনটুলীর দেহপসারিনীদের জীবনে প্রায় একই গল্প!
ছায়া বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বললে, নোটিশে তো তাই লেখা আছে।
হয়ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু বলা হল না। তারই নাম ধরে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এল এক মাতাল। ভাঙা চেহারা।
—”যাও গো ছায়াদি। তোমার খদ্দের।”
—”বুড়ো ভাম মরেও না। ঘরসংসার থাকতেও…”
—”ও কথা বোলোনি গো। ওরা আসে বলেই আমরা বেঁচে আছি।”
লোকটা গায়ের কাছে এসে হামলে পড়ে মুখে পচাই মদের গন্ধ ছেড়ে বলে, “হেই দ্যাকো ছায়াসোন্দরী, তু এখেনে? আর আমি তোরে খুঁজ্যা মরচি।”
—তুই আমার তিনকালের ভালোবাসার মানুষ যে রে! তুই না খুঁজলে কে খুঁজবে বল? ক’ট্যাঁকা এনেচিস?”
—”সব। একদিনের কামাই। শুধু কুড়ি টাকার পচাই খেয়েচি।”

নোট কয়েন মিলিয়ে পঞ্চাশ মতো হতে পারে। সকাল থেকে একটাও খদ্দের আসেনি। এরপর যদি একটাও না আসে?
আশঙ্কার ছায়া ফুটে ওঠে তার দু’চোখে। লোকটাকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে ঘরে আসে। এই ঘরের বাইরে প্রচুর আলো থাকলেও এ-ঘরে বেশ অন্ধকার। এতে অবশ্য সুবিধাই হয়। কষ্ট করে আর আলো নেভাতে হয়না।
কিন্তু ভাবনাটা থেমে থাকে না। পরদিন ছায়া সহ আরও কয়েকজন গণিকা পুরসভার বাস্তুবিভাগে হাজির হয়। উৎসুক জনতা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। ছি! ছি! কি লজ্জা! গণিকারা এসেছে বাস্তুবিভাগে? দারোয়ান পথ আটকে জিজ্ঞেস করে, “তুমলোগ যায়েগি কাঁহা?”
—”অন্দরমে।”
—”মগর কিঁউ?”
—”সাহেবকো সাথ প্রেম করেগি?”
চোখ মারে আশা পেশাগত দক্ষতায়। তাতেই দারোয়ান বেসামাল হতেই ওরা ভেতরে আসে।
হঠাৎ বেশ কয়েকজন মহিলা বিনানুমতিতে তার চেম্বারে প্রবেশ করায় বিষ্মিত হয় তরুণ ইঞ্জিনিয়ার উৎপল গোস্বামী।
—”আপনারা?”
—”আ-মর! আমরা কারা তাও জানে না। আমরা নষ্টা মেয়ের দল। আপনার কাছে একটা আর্জি আছে।”
—”বসুন।”
ওরা বসলে তিনি বললেন, “আপনাদের আর্জিটা?”
—”বাড়িটা ভেঙে ফেলবেন?”
—”কোন বাড়িটা?”
—”মহাজনটুলীর যে বাড়িটায় আমরা থাকি। বাড়িটা ভেঙে ফেললে আমরা কোথায় যাব বাবু।”
—”সেটা আবাসন বিভাগ বলতে পারে। আসলে বাড়িটা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।”
—”সত্যিই ভেঙে পড়তে পারে?” ছায়া প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সরাসরি।
মৃণালিনী বলল, “আমরা শুনেছি জায়গাটা প্রমোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।”
উৎপলবাবু সেই মুহূর্তে কোনও কথা বলতে পারেন না। কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বললেন, আপনারা সভাপতির সঙ্গে কথা বলুন।
কিন্তু সভাপতির ঘরের সামনে পুলিশ ওদের আটকে দেয়। বিদেশি শিল্পপতিরা আসবেন। তাই নিষিদ্ধ জগতের মেয়েদের এখনই চলে যাওয়া উচিত।
—”কেন?”
রমলা রুখে দাঁড়ায়। বলে, “আমাদের যেতে দিতেই হবে। নাহলে জোর করে যাব।”
—”নেহি।”
এগিয়ে আসে আর একজন। রমলা ঠেলে দিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু শেষমেশ পারে না। বেশ কয়েকজন পুলিশ ঘিরে ধরে ওদের। চোখে আদিম লালসা। একজন পুলিশ বলে লক আপে পুরে আচ্ছাসে টাইট দিতে হবে।
ওরা থেমে থাকে না। মৃণালিনীর এককালের খদ্দের বর্তমানে এমএলএ তথা ডাকসাইটে নেতা, শাসকদলের কেউকেটা সবাই মিলে ওর কাছেই গেল। দারোয়ান প্রথমে ঢুকতে দিতে চায়নি। কমবয়সী অঞ্জু ওকে ইশারায় নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। দারোয়ান এরপর আর কথা বলেনি। কারণ অঞ্জুটা দেখতেও বেশ!
এমএলএ সব শুনে বললেন, না ভাঙা হবে না। কিন্তু একটা শর্ত। মৃণালিনীর একমাত্র মেয়ে যে বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করছে তাকে এক সপ্তাহের জন্য ছেড়ে দিতে হবে।
আঁতকে উঠল মৃণালিনী। না, ওকে সে এই পাপব্যবসায় নামতে দেবে না।
গণিকারা মৃণালিনীর মুখ দেখে হতাশ হল। গণিকার মেয়ে গণিকা হবে এতে লজ্জার কী আছে! আর তাছাড়া রাজি না হলে যে তাদের সবাইকে মরতে হবে।
সেই মুহূর্তে রাজি না হলেও, রাজি হতে হল মৃনালিনীকে। না-হলে যে উপায় ছিল না।
একমাত্র মেয়ে অনুপমাকে বলল, “তোর এক মামার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”
মামার বাড়ি পৌঁছে আশ্চর্য হল অনুপমা। এতবড়ো বাড়ি মামার। তবু মাকে ওই নোংরা পাড়ায় থাকতে হয়। দেহ বিক্রি করে দিন গুজরান করতে হয়।
প্রথম আলাপে মামাকে যথেষ্ট ভদ্র বলে মনে হল তার। কিন্তু রাত বাড়তেই মামার ভদ্রতার মুখোশ খুলতে থাকে। গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠে বলে, “একি করছেন?”
এমএলএ মামা হাসতে থাকে।
অনুপমা পালিয়ে যেতে চাইলেও পারল না। নীল আলোয় একপ্রকার মায়ের চোখের সামনেই তাকে হারাতে হল তার কুমারীত্ব।
মৃণালিনী চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বাড়িটা থাকবে তো?”