দেহধারণ -কৌশিক কারক

এ তুমি কী বলছ শেখর? এতদিন এভাবে এত কষ্ট করে সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পর আজ তুমি একথা বলছ!”
“তুমি ঠিকই শুনছ সোমা, আমার পক্ষে আর এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।“
অনেকদিন ধরেই সোমাকে কথাটা বলব বলব ভাবছিল শেখর। কিন্তু পারেনি। কিন্তু সবকিছুরই একটা শেষ থাকে। তাই আজ সাহস করে একদম সোজাসাপটা ভাবেই কথাটা বলেই ফেলল।
কথাটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হলেও প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সোমা বলল, “কেন শেখর? আমি কী দোষ করেছি যে তুমি আমার সাথে এমন করছ?”
“দোষ তোমার নয় সোমা। একদমই নয়। দোষ সম্পূর্ণরূপে আমার, আর যদি ঠিকঠাকভাবে বলতে চাই তাহলে দোষ পুরোপুরি আমার কপালের।”
“কীসব হেঁয়ালি করে কথা বলছ! যা বলার একটু পরিষ্কার করে খুলে বলবে? আমি কিন্তু এইরকম কথাবার্তা একদমই পছন্দ করি না।”
“পরিষ্কার করে খুলে বললে কি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে? শোনো সোমা, আমি জানি তুমি আমার কথায় বিশ্বাস করবে না, গতমাসের এগারো তারিখে এক্সাইড মোড়ে যে বাস অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিলো তার মধ্যে একটা বাসে আমি ছিলাম। দুটো বাসের যে বাইশজন যাত্রী মারা গিয়েছিল আমি তাদের মধ্যে একজন। আমি সেখানেই মানে ঘটনাস্থলেই মারা যাই। এই গত কুড়িদিন ধরে আমি অনেক কষ্টে দেহধারণ করে তোমার সাথে দেখা করছি। কিন্তু এটা একজন আত্মার পক্ষে খুব যন্ত্রণাদায়ক। আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আর আমি পেরে উঠছি না। এবার না চাইলেও আমাকে চলে যেতে হবে। আর তোমাকেও আমি একটা মিথ্যে জীবনের, মিথ্যে আশার মায়ায় আটকে রাখতে আমি আর চাই না——– একী? তুমি হাসছ! ওহ! আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তবে এই দেখো, দেখো ভালো করে,—আর কি দেখতে পাচ্ছো আমায়? “
“পাচ্ছি তো। বেশ পাচ্ছি। কেন পাবোনা। হা! হা ! হা!”
“সেকি!! তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ! কী করে?“
“আরে সেটাই তো। এতদিন ফালতু দুজনে কষ্ট করলাম। আর আমি হাসছি অন্য কারণে। জানো তো শেখরদা, আমার না রাস্কিন বন্ডের ‘দি আইস হ্যাভ ইট’ গল্পটার কথা মনে পড়ছে। ওই যে সেই গল্পটা , যেখানে ছেলেটা জানতে দিতে চায়না তার সহযাত্রী মেয়েটাকে যে সে অন্ধ, আর সেই চেষ্টায় সে বেচারা নিজেও বুঝতে পারেনা যে ওই মেয়েটাও অন্ধ ছিল। আর যখন জানতে পারে তখন আর কিছুই করার নেই। মেয়েটা ট্রেন থেকে নেমে গেছে ততক্ষণ।”
“আমরা দুজনে কষ্ট করলাম মানে? আর কী বলছ? রাস্কিন বন্ডের গল্প? ”
“আরে বাবা এখনও বুঝতে পারোনি? তুমি যে অ্যাক্সিডেন্টটার কথা বলছো তার একটা বাসে তো আমিও ছিলাম। আমিও তো ওইদিনই মারা গেছি। তুমি ঘটনাস্থলে মারা গেছ , আর আমি মারা গেছি হাসপাতালে গিয়ে, ওইদিন রাত্রে। তাই একে ওপরকে তখনই দেখতে পাইনি। ইসসস! আমিও যদি সঙ্গে সঙ্গে মারা যেতাম। তাই বলছি আজ থেকে আর আমাদের দেখা করার জন্য দেহধারন করতে হবে না। ভাগ্যিস আজ আমাকে বললে, নাহলে ওই গল্পটার মত তুমিও জানতে পারতে না যে আমিও তোমার মতনই এখন আত্মা।”
“তুমি সত্যি বলছো সোমা?”
“হ্যাঁ গো। আর কোন চিন্তাই নেই আমাদের। দেহছাড়াই আমরা দুজন একসাথে থাকবো। যেখানে ইচ্ছে যাবো। কেউ বাধা দেওয়ার নেই গো। দুজনেরই দেহধারনের কষ্ট থেকে মুক্তি।“