“ইউ ফিলথি, ডার্টি ওয়ান, হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি? যা যা ভাগ নইলে এমন মারব”—গাড়ি থেকে নামা সুবেশী মধ্য বয়স্ক ভদ্রমহিলার চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হয়ে যায়।
“কি হয়েছে দিদি পকেটমার? দিন না সবাই মিলে দু’ঘা” অথবা “এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলো নেশা করার জন্য ভিক্ষা চেয়ে বেড়ায়, আসলে এদের অনেক টাকা এদের মা-বাবাগুলোই এদের দিয়ে সব করায়।”
চারদিক থেকে যখন এমন সরস এবং জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য ভেসে আসছে তখন নন্দিনী এগিয়ে যায় ভিড়ের মাঝে। দেখে একটি বছর সাত-আটেকের বাচ্চাকে এক-দু’জন খুব বকাঝকা করছে, এমনকি মারতেও যাচ্ছে অথচ তার কথা কেউ শুনছে না। নন্দিনী উত্তেজিত জনতাকে একটু ঠান্ডা করার চেষ্টা করে ছেলেটিকে বলে— “কী রে? কী করেছিস তুই?”
ছেলেটি বলে— “ওই মাসিমার ছোট হাতব্যাগটা গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছিল, সেটা দেওয়ার জন্য ওকে হাত ধরে ডাকছিলাম। আর উনি ভাবলেন ভিক্ষা চাইছি তাই জন্য…” বলেই কেঁদে ফেলল।
—”কোথায় থাকিস? কী করিস? কী নাম তোর?” এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলল নন্দিনী।
—”বিল্টু দিদি, ওই খালপাড়ে থাকি ভিক্ষা করি।”
—”চল আমার সাথে” বলেই হতভম্ব জনতার মাঝখান থেকে ছেলেটাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে নন্দিনী।
স্কুলের রোল কল পড়ার সময় ভুবন স্যার বাজখাঁই গলায় ডাকলেন,”নন্দন চ্যাটার্জি?” শেষ বেঞ্চ থেকে মৃদু গলায় নন্দন উত্তর দেয়—”ইয়েস স্যার।”
—”তা বাপু তুমি অমন মেয়েদের মত মিনমিনে গলায় কথা বলো কেন? তোমাকে দেখে তো মনে হয় ভগবান মেয়ে বানাতে বানাতে ছেলে বানিয়ে দিয়েছে। যত্তসব!”
স্যারের কথায় হাসির রোল ওঠে ক্লাস জুড়ে।

নন্দনের এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে। সত্যিই তার ভিতরে সত্তাটি যেন পুরোপুরি এক নারী। নারীর মতো একবুক কোমলতা, শরীর জুড়ে নারীসুলভ মিষ্টি গন্ধ। মাত্র দু’বছরের দিদির সাজার জিনিস, জামা কাপড় এমনকি অন্তর্বাসগুলোও বড্ড আকর্ষণ করত নন্দনকে। দিদির কাছে নারী শরীরের সব গল্প শুনত আর নিজেকে নারীরূপে ভাবতে বড্ড ভালো লাগত তার। ঘরে বাইরে হাজার অপমান সত্ত্বেও এই গোপন সত্তাটিকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না নন্দন। একটু বড় হতে নিজের জন্য কেমন যেন জেদ চেপে গেছিল। কাছের মানুষ এবং সমাজের সব ভ্রূকুটি পাশে সরিয়ে রেখে নিজেকে প্রমাণ করেছিল সমাজের চিরচরিত সামাজিক ও আর্থিক সাফল্যের দাঁড়িপাল্লায়। প্রথমে হাই স্কুলের টিচার পরে কলকাতার বিখ্যাত এক ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের প্রফেসর। সামাজিক মাপকাঠিতে নিজেকে দাঁড় করাবার পরে নিজের আজীবন লালিত ইচ্ছেটাকে সম্পন্ন করতে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত করেছিল নিজেকে। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। নিজের কাছের লোকেদের এবং পরিচিত সমাজকে ছাড়তে হয়েছিল। আজ শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে সে তার নিজের একটি ছোট্ট আশ্রম করেছে সমাজের অবহেলিত মানুষদের জন্য। নন্দন আজ নিজের বিবিধ সুকর্মের গুণে সমাজ এবং মিডিয়ায় পরিচিত মুখ রূপান্তরকামী “নন্দিনী চ্যাটার্জি”।
ট্যাক্সিটা এসে একটা আশ্রমের সামনে দাঁড়াল, ‘অন্য মায়ের আশ্রম’।
—”ও দিদি এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে? এখানে কী আছে? সকাল থেকে কিছু খাইনি খুব খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দেবে? আমায় পুলিশে দেবে না তো?”
আরো কিছু বকবক করছিল বিল্টু। নন্দিনী হাসিমুখে বলে, “দিদিকে বিশ্বাস করে আয় দেখবি এ এক সুখের রাজ্য।”
ভিতরে ঢুকে ভারতী নামে এক মহিলাকে নন্দিনী বলে বিল্টুকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে পরিষ্কার করে খাবারের ঘরে নিয়ে আসতে। এ বছরই প্রথম বার আশ্রমে দুর্গাপূজা হচ্ছে, আজ পঞ্চমী, প্রচুর কাজ বাকি। কাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে ব্যস্ততা আর হুল্লোড় আনন্দ উৎসব। জরুরি সব কাজ সেরে নিজের ঘরে গেল নন্দিতা। স্নান করে নতুন জামা প্যান্ট পড়ে একটা বড় ঘরে এসে বিল্টু দেখে বিভিন্ন বয়সি আরো জনা তিরিশ বাচ্চারা খাবার ঘরে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা শালপাতার খালায় দুপুরের খাবার সাজান। নন্দিনী নিজেও স্নান সেরে খাবার ঘরে এসে সকলকে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া শুরু করতে বলে। বিল্টু চোখ ভরা জল নিয়ে দৌড়ে এসে প্রণাম করে নন্দিনীকে। তারপর নন্দিনীর একটা হাত উঁচু করে ধরে শরীরের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “বলো দুগ্গা মাই কি……”
কী আশ্চর্য! আরও অনেকগুলো গলা একসঙ্গে বলে ওঠে, “দুগ্গা মাই কি জয়…….”
বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মোচড় দিয়ে উঠল একসময়ের নন্দন চ্যাটার্জি আর আজকের নন্দিনী চ্যাটার্জির “হে আমার প্রাণসখা মোর মাতৃসম বঙ্গভূমি, তোমার শাড়ির ভাঁজে মুখ লুকানো চোরকাঁটাদের মুক্ত করবো আমি।”
মর্মস্পর্শী। গল্পের প্রথম অংশ টুকু যা লেখা তার হয়তো প্রায়শই দেখা যায়। আজকাল মানুষের স্থৈর্য আর ধৈর্য্য দুটোই বড্ড কমে গেছে। তাই সবটা বোঝার আগেই react করে ফেলেন।তবে গল্পটা খুব ভালো লাগলো।