জীবন যেমন: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
বেগবান নদীর স্রোত আছড়ে পড়ে। জীবনে সুখ-দুঃখ ভিড় করে অহরহ। মানুষের জীবনে দশ-দশা, কখনো হাতি কখনো মশা। এই তো জীবন, নানান জীবনের কাহিনী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে লেখা, চরিত্র ও সময়ের আঙিনায় প্রস্ফুটিত। বিশেষ করে চলমান আধুনিক জীবনযাত্রার বেড়াজালে সুখ- দুঃখ, হাসি-কান্না, আপদ-বিপদ স্রোতস্বিনী নদীর মত বয়ে চলেছে। যেখানে যেখানে যেমন স্রোতধারা, সেখানে সেখানে তেমন জীবনধারা। কোথাও কেবল পাহাড় থেকে শৃঙ্গ জয়, তারপর আকাশ, আকাশ থেকে নীলাকাশ শূন্যে রওনা দেওয়া, যে উচ্চ ভিলাসের কোনও শেষ নেই। আবার দূর থেকে সরষের খেত ঘন হলুদ কার্পেট, কাছে এলেই ফাঁকাময়। বস্তুত আমাদের এই জগৎ জ্ঞান-অজ্ঞানতায় জরাজীর্ণ। যার বাইরে আমাদের বিচারধারা ও প্রকাশের যোগ্যতা নেই। সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, আনন্দ-বিষাদ আবর্তনে সীমাবদ্ধ। একটি সীমার উপর এই মহাকর্ষে যেমন অক্সিজেন অপ্রতুল, তেমনি আধুনিক সমাজ প্রকোষ্ঠের বাইরে আমরাও বেমানান।
এই ঘূর্ণায়মান সমাজে আমরা শুধু চলেছি…শুধু চলেছি। বলি, আমাতেও তার ব্যতিক্রম নেই। এই সায়াহ্নে আমার বর্তমান জীবন চক্রে ,জনারণ্যের আবাসিক শহরে আমি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার সাক্ষী। একের পর এক দণ্ডায়মান আবাসনের খাঁচায়, নির্দিষ্ট সাথীর সান্নিধ্য, যেখানে উদাস মন আকাশ সূর্য ছাড়াই বিষাদ অতলে তলিয়ে যেতে উদ্যত হয়, আবার বাইরে সেই জনারণ্য কোলাহলে ব্যতিব্যস্ত জীবন। এ যেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।
নিস্তার পেতে, মা গঙ্গা অনন্ত প্রবাহমান গঙ্গাই ভরসা। চল যাই দোলতলা ঘাটে, এমনি জায়গা চার দণ্ড বসলে যেন মন প্রান জুড়িয়ে যায়। আবালবৃদ্ধবনিতা শুদ্ধ শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রতিনিয়ত কাটিয়ে যান। গঙ্গার দোলতলা ঘাটে আমার প্রতিদিনের সফর, টায়ারে হাওয়া ভরার মত, না হলে চাকাই ঘুরবে না। রোজ যখন গিয়ে বসি, একটা জমজমাট আসর, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কপোত-কপোতি, ছোট কিউট বাচ্চারা, কারা নেই সেখানে। হকারও তাদের সামগ্রী নিয়ে জীবন চালাতে ব্যস্ত। আমি কিন্তু জলের একদম কাছের ধাপিতে বসতে ভালবাসি। ছোটো-বড়ো ঢেউগুলো আমার পায়ের কাছে এসেই যেন কোথায় মিলিয়ে যায়।
ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মাঝে পা দুটো কে ঝুলিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বয়স কি করে লুকোবো। ইচ্ছা দমনীয়। খুব কাছ থেকে পাল তোলা নৌকাগুলো হুস্ হুস্ করে চলে যাচ্ছে। “ও মাঝি রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে।” মনে হয় আমি যেন নাওয়ে বসে, আর মাঝি গান গেয়ে চলেছে। ছাই রং এর ডলফিন হঠাৎ হঠাৎ হস্ করে শব্দ করে জলের উপর পিঠ দেখিয়ে নৌকার আগে দৌড়ে চলে। সে নৌকার সঙ্গে রেসে হারতে চায় না। মাঝ গঙ্গার স্বচ্ছ জল তালুতে নিয়ে ভাবতে থাকি, এই জল ছোঁয়ায় সব পাপ কেন বিনাশ হয়। গঙ্গা জলে স্নান করলে সব পাপ কেন ধুয়ে মুছে যায়।
সম্বিত ফেরে ওপারের রানি রাসমণির সাধের দক্ষিণেশ্বরের আলো ফটাফট জ্বলে ওঠায়। আলো ও মন্দিরের প্রতিবিম্ব গঙ্গার জলে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মা সারদা, রামকৃষ্ণ কে প্রণাম করে উঠতে যাব, হঠাৎ দেখি বির্সজন হওয়া ঠাকুরের একটি মুকুট ভেসে ভেসে আমার দিকেই আসছে। লোভ হল ওটাকে নেবার, জলে নামতে উদ্যত হতেই, পিছন থেকে চিৎকার। ” দাদা নামবেন না, চোরা বালি থাকতে পারে।”
তাকাতেই দেখি এক প্রৌঢ়।
-“মানে….?”
-“কেন যাচ্ছেন শুধু শুধু। বিপদ হতে পারে।”
বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম।
-“সন্ধ্যা হয়েছে চলুন বাড়ী যাওয়া যাক।”
-“চলুন…।”

গঙ্গার দোলতলা ঘাট সংলগ্ন জি টি রোড। রাস্তায় গাড়ির খুব ভিড়। রাস্তা পারাপার করতে মিনিমাম পনেরো মিনিট সময় লাগে। রাস্তার ওপারে পৌঁছে দুজনে চলছি। ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, “আপনার নাম কি? কোথায় থাকেন?”
-“আমার নাম…….. দেব ব্যানার্জ্জী। এই পি সি সেন লেনে থাকি।”
-“আপনার নাম?”
-“আমি স্বদেশ বিশ্বাস। জে কে রোড। উল্কা এপার্টমেন্ট।”
-“আমি রোজই দেখি, আপনি ঘাটের শেষ ধাপিতে বসেন। আমি একটু ওপরে বসি। আজকে ঘটনা চক্রে আলাপ হয়ে গেল।”
-“ঠিকই বলেছেন।”
-“আলাপ যখন হল, তখন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে, একটু বসে গল্প করি।
জীবন যেমন,তার মাঝে আর একটু সময় কাটাই।”
-“না…. না…… আজ নয়,অন্য কোনো দিন, দেরি হলে ফোন আসবে।”
-“বলবেন নতুন বন্ধু পেয়েছি, একটু গল্প করে বাড়ি ফিরছি।”
-“আচ্ছা…….., তবে চলুন…..।”
খেয়ে ঘাট অবধি এসে বাঁ দিকে জে কে রোড এ ঢ়ুকে পরলাম। অনতিদূরেই উল্কা এপার্টমেন্ট। বিশ্বাসবাবু দোতলায় ফ্ল্যাটে ড্রইং স্পেসে আমাকে বসালেন। বললেন, “ব্যানার্জ্জী বাবু বসুন…. । আমি চা বানিয়ে আনছি, দুজনে বসে খাবো, আর গল্প করব।”
-“আচ্ছা…..”
চোখ পরে গেল ফ্ল্যাটে, নিখুঁত ভাবে সব কিছু সাজানো। মনে হচ্ছে সব নতুন। ভদ্রলোকের এলেম আছে বলতে হবে। বলতে বলতে চা এসে গেল।
-“নিন চা খান।”
-“হাঁ…. , বলি আর কেউ নেই বাড়ীতে?”
-“কেন বলুন তো?”
-“না….. তাই জিজ্ঞাসা করছি। স্ত্রী,ছেলে- মেয়ে…….?”
-“হাঃ হাঃ হাঃ …… স্ত্রী ছাড়া আমার সবাই আছে ব্যানার্জ্জী…. । ছেলে, মেয়ে, ধনী আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী। কিন্তু ঘরে দেখছেন তো কেউ নেই, আমি একা।”
-“কিন্তু কেন…?”
ছেলে থাকে নিউইয়র্কে, বায়ো ল্যাবের চিফ, ওখানেই সংসার। মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায়, এক হাইটেক আই টি ফার্মে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী অনেক আগেই আকাশের তারা হয়ে গেছেন।”
-“আপনি ওদের ছেড়ে এখানে একা পরে আছেন?”
-“ঠিকই….., আসলে, ওখানে দোলতলার মত গঙ্গার ঘাট নেই। গঙ্গার বিশুদ্ধ বাতাস নেই। আপনার মত বন্ধু নেই। সেন্টিমেন্ট নেই। অর্পনা নেই। বিশু, নন্টে, ভাকুর মতো পাড়ার ছেলে নেই।”
-“তার মানে……….? আপনি ঘরে একা। রাতবিরেতে কিছু হলে………?”
-“হাঃ হাঃ হাঃ …… প্রতিটি মানুষই একা, একাই আজীবন, জীবনের প্রতিটি স্তরে তার ভিন্ন ভিন্ন নামের সহযাত্রী জোটে বটে, কিন্তু তাতে হৃদয়ের নির্জনতা ঘোচে না।
পাড়ার ছেলেরা দিনে রাতে চার বার আসে আমার ঘরে। কলিং বেল বাজায়। যদি আমি সাড়া দিই, ওরা চলে যায়, আর যদি সাড়া না দিই, বলা আছে পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে ব্যাবস্থা করবে। অর্পনা দুই বেলা রান্না- বান্না করে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আর কি চাই!”
“তবে কিছু সমস্যাও আছে জানেন.. ।
ছাতার মত গজিয়ে ওঠা আশ্রমের লোক মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে। বলে, আপনার সবকিছু এই আশ্রমকে দান করুন জীবনস্বত্ব করে। আপনি ওখানে ভালো থাকবেন। কেউ কেউ স্বামী- স্ত্রী সেজে আসে, বলে তারা নাকি আমাকে দেখবে। পরম আত্মীয়রা তো আমার পিছনে পড়ে আছেন।”
“কী ভাবছেন? রাত্রে ছাদে ওঠেন? শুকতারা দেখেন? কেমন সদর্পে জ্বল জ্বল করছে। সপ্তর্ষীমণ্ডল যুগ যুগ ধরে জিজ্ঞাসা হয়ে প্রশ্ন করছে! সূর্য ভোরের আলোয় জাগাচ্ছে। দিন-রাত্রি, জন্ম-মৃত্যু একই টিউনে চলছে। কিসের ভাবনা- ভয়…….!”
-“আচ্ছা আজ আমি আসি বিশ্বাস বাবু। আবার দেখা হবে। বেরিয়ে পরলাম। উল্কা এবং পি সি সেন লেনের মাঝে আমি। ভাবনা তো আছেই, মনে হয় সৎসঙ্গ সর্বদাই দরকার। গঙ্গার যত কাছে যাব, ততই শীতল হাওয়া পাব, অগ্নির যত কাছে যাব, ততই উত্তাপ পাব। জীবন যেমন।
One thought on “জীবন যেমন: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়”