জীবন যেমন(৫ম পর্ব):ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
গঙ্গা বক্ষে নৌকায় বসে কিছু যাত্রীর সঙ্গে আমি বয়ে চলেছি। মাঝি তার বৈঠার আঘাতে জলের স্রোতকে আয়ত্ত করে নৌকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। চারিদিকে শুধুই জল আর জল। কেমন যেন মনে হল, এই মনমোহিনী, অপরূপ, স্রোতস্বিনী গঙ্গার কল-কল, কুল-কুল শব্দ অনেক দিনের চেনা। এই বিস্তীর্ণ জলরাশির নিস্তব্ধ নীরব গঙ্গার অনুভূতি নির্দিষ্ট বর্ণে-গন্ধে ভরপুর। যদিও জলের কোনও বর্ন-গন্ধ নেই। তবু যেন এক নির্মল গন্ধ নিঃশ্বাসের মধ্যে। পৃথিবীর মাটির গন্ধ এইরূপ। মা-গঙ্গার জলের স্পর্শ অনুভবের।
এই মুহূর্তে নিজেকে উদাস মনে হল। মনে হল এই খেয়া যেন শেষ না-হয়। তীরে না ভিড়ে যেন চলতেই থাকে। দু-চোখ বুজে রইলাম। গভীর জলে ভাসমান নৌকার শিরশির আওয়াজ, বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ। অদূরে জল-জীবের ভেসে ওঠার শব্দ। সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর, ভয়-ভয়, অদ্ভুত।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, আকাশের বুকে রোদ আর মেঘের খেলা। নদীর জলে ছায়া। ঠিক মাথার উপর দুটো কাক পাশাপাশি উড়ে নদী পারাপার করছে। আমাদের পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেল। নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হল। মনে হল মাটি ছাড়া, আকাশ, জল, পাতালে মানুষের অস্তিত্ব কত ক্ষীণ।
আরও কিছুক্ষণ, পৌঁছে যাব ওপারের খেয়া-ঘাটে। সেই মাটি, সেই প্রসিদ্ধ জীবন্ত ইতিহাস, মা ভবতারিণীর ঠিকানায়। মানুষের ঘরে ঘরে মনে প্রাণে রানি রাসমণি। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, মা সারদা আছেন। যার মিশন, ভিশন আজ বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিক আলোচনার বিষয় হয়েছে সেই রামকৃষ্ণ মিশন। “আত্মার মোক্ষ ও জগতের কল্যাণের নিমিত্ত।”
অবশেষে তরী তীরে এসে ভিড়লো ঘাটে। আমরা একে একে কাঠের পাটাতন বেয়ে উপরের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। পাশেই সেই অবিস্মরণীয় দক্ষিনেশ্বরের স্নান ঘাট। এই ঘাটেই কতদিন গদাধর চট্টোপাধ্যায় মা সারদাকে নিয়ে ধ্যানে মগ্ন হতেন। পৌঁছে গেলাম মন্দির বাইরের চত্তরে। বাইরে থেকে প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকলেই শ্রী রামকৃষ্ণদেবের ছবি। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, যে কেউ ভক্ত আসছেন, শ্রী রামকৃষ্ণদেব যেন বলে উঠছেন,”সবার চৈতন্য হোক।”

আর একটু এগিয়ে গেলেই, স্বামী বিবেকানন্দের অবয়ব চোখে পড়বে। আকৃতির দিকে তাকালেই মনে পরবে, সেই বিখ্যাত বাণী: “জেগে ওঠো, সচেতন হও, এবং লক্ষ্যে না-পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।”
এর পিছনেই অনেক পূজা-সামগ্রীর দোকান। পাশেই রয়েছে দেব-দেবীর মূর্তির দোকান। ভক্তবৃন্দের খাবারের দোকান। ইতিহাসের পাতায় প্রসিদ্ধ জমিদার রানি রাসমণি এই কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আবার ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ যখন এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন, তখন এই গঙ্গার তীরে মন্দির প্রাঙ্গণ ছিল সবুজে ভরা।
জুতো ছেড়ে, স্নান ঘাট হয়ে, সিকিউরিটি গেট অতিক্রম করে মন্দির প্রাঙ্গণে যখন প্রবেশ করলাম দেখি এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত বিরাট লাইন। সকলের হাতে শালপাতার থালায় পূজা সামগ্রী, লাল জবা। আমি তো কিছু নিয়ে আসিনি, তবে…? এখানে আসা মানেই মা ভবতারিণীর পূজা-অর্চনা করা। কিন্তু মন বলছিল, এই পুণ্য ভূমি ঘুরে ঘুরে দেখি না, এতেই বা দোষ কি…? শুরু করলাম দেখা— বারো আটচালার শিব মন্দির। “সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি, তুরীয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন।
একে একে শ্রী শ্রী রাধাকান্তের মন্দির,নাট মন্দির হয়ে মূল মন্দির নবরত্ন মন্দির দর্শন করলাম। হঠাৎ এক ভক্তের হারমোনিয়ামে “শ্যামা মা কি আমার কালো ” গান শুনতে পেলাম।
বড় চাতালে উঠে দূর থেকে মায়ের দর্শন হয়। তাই মাকে দেখলাম। এক-এক করে দর্শনার্থী ভক্তদের পূজা চলছে। ঘণ্টা, শঙ্খ, উলুধ্বনিতে মা মঙ্গলাকালী, ভদ্রকালী, কপালিনী, ক্ষমাধাত্রী, চৈতন্যময়ী, করুনাময়ী-বিশ্বধারিনীর আরাধনা চলছে।
এরপর রামকৃষ্ণদেবের বাসগৃহের দিকে রওনা হলাম। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আজ নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু তাঁর ইতিহাস আছে, বাণী আছে। তাই তিনি মনের পাতায় এসে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য। “যত মত তত পথ, সব ধর্মই সত্য, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হল ভালোবাসা।”
এই পুণ্যভূমির পূজা প্রাঙ্গণ ছাড়লাম কিছু চিন্তন আর ভাবাবেগ নিয়ে। মা ভবতারিণীর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে রোজ হাজার-হাজার মানুষ আসেন। মায়ের চরণে পূজা-অর্ঘ্য প্রদান করেন। কেউ আসেন নিরোগ হতে, কেউ বা সন্তানের সাফল্যে, নিজ সিদ্ধিলাভে, হয়তো বা কেউ সত্য পথে ঈশ্বরকে খুঁজতে। কে কী পান তাঁরাই জানেন। তবে একথা সত্য ১৮৫৫ সালে যখন রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক পথকেই বেছে নেওয়া যা মানব জীবনের মুক্তির পথ আর আমরা নিশ্চিত যে তাঁর পরোক্ষে উদ্দেশ্য ছিল কর্মসংস্থান। না-হলে এই প্রাঙ্গণ জুড়ে বিশাল বিশাল অট্টালিকা, হোটেল, পূজা-সামগ্রী বানানোর কারখানা দোকান গজিয়ে উঠেছে কেন? কত মানুষ যে সেখানে জীবন জীবিকায় লিপ্ত ভাবা যায় না। শুধু ভিখান্নে বাঁচা অসহায় মানুষের ছাপ এখানে পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না, এর উত্তর আমার জানা নেই।
চলতে চলতে মন্দিরের বাইরে বিশাল স্কাই-ওয়াকের সামনে দাঁড়িয়েছি। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, মা ভবতারিণীর মন্দিরের চূড়া। দূর থেকে দেখা যায় স্রোতস্বিনী গঙ্গা, স্নানঘাট, বালিব্রিজ ,গাড়ি টেম্পো, লোকাল ট্রেনের চলাচল। নদীর ওপারে অট্টালিকা, সবকিছু যেন ছবির মতো। আবর্তে ঘুরছি আমরা। এক একটা দিন অতিবাহিত হয়, এক একটা অতীত সৃষ্টি হয়। দিনের শুরু বর্তমান জীবন যেমন। ভবিষ্যৎ কী তা মহাকালই বলে দেয়।