Recent Post

জীবন যেমন(৩য় পর্ব): ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়

জীবন যেমন(৩য় পর্ব): ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়

আগের পর্বটি পড়ুন

জীবন কারোর জন্য কখনও থেমে থাকে না। জীবন থেমে যায় যখন সে নিষ্প্রাণ।  জীবন কখনো কখনো সমুদ্রের ঢেউ, গর্জন করে তীরে আছড়ে পড়ে, কত মণি-মাণিক্য নিয়ে আসে। কত কিছু ফিরিয়ে দেয়।  আবার নদীর শান্ত-নির্মল ঢেউয়ে পাড়ি দেয়, জীবন স্নিগ্ধ স্নানে অবতীর্ণ করে।  জীবন কখনো ঝোড়ো হাওয়া, আবার ফুরফুরে বাতাস। গতিশীলা তার নির্দিষ্ট অহংকারে। কিন্তু জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে, “জীবন যেমন” তা অলঙ্কৃত করে দৃশ্যপটে, নানা পথ নানা মতে। আমার দৈনন্দিন জীবনে, আমি যে ভাবে চলেছি, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তার দৃশ্যপটে, অনুভবে।  মুহূর্তেই মন প্রান কে আলোকিত করে।  কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই আমার ভাবনা চিন্তা কে দীর্ঘায়ু করে।

প্রত্যেক ভোরের পরে সকালে, সুপ্রভাত কামনা করি।  সূর্যাস্তে পুনরায় সূর্যোদয়কে আহ্বান করি। এরই মাঝে অসংখ্য ঘটনা জন-অরণ্যে ঘটে চলে।  বিশ্বভরা প্রানে তার সাক্ষী থাকে আকাশ-বাতাস,পশু-পাখি,

জীব মনুষ্যের দল। কেউ তার হিসাব রাখে, আবার অনেক কিছুই হারিয়ে যায়।  হিসাবের খাতা একই আবর্তে চলমান।  নদীর এক পাড় থেকে আর এক পাড়ে আনাগোনা। আবহমান কালের শপথ।  হারিয়ে যাওয়া ফিরে এসে যদি আশার প্রদীপ জ্বলে, তবে সেই আলোই চলার পথকে দীপ্ত করে।  

শৈত্যের অবসানে, গরমের আবির্ভাব, এর জন্য প্রত্যুষ খুব কামনীয়। সকাল সকাল উঁচু তলার আবাসন থেকে রাস্তায় জীবন-যুদ্ধের ডাক শোনা যাচ্ছে। পুরোনো বই-খাতা… লোহা, কেউ আবার ফুচকা…।   ভাবতে অবাক লাগে, এক সঙ্গে ঠেসে বসবাস, অথচ কত অসংখ্য বিভাজন।  বিশ্বব্যাপী প্রানের বর্গীকরণ। খাওয়া-পরা, বাঁচা-মরার লড়াই। এই লড়াইয়ে জিততে হবে।  

আজ ইংরাজির ৪ঠা মার্চ।  ধীরে ধীরে ধরনী উত্তপ্ত হচ্ছে। অরণ্যের পরিবেশ যেমন শিমুল-পলাশের রঙে আগুন, তেমনি এই মুহূর্তে দেশ-শহরের বাতাস উত্তেজনায় ভরপুর। উত্তোলিত ঝান্ডার রূপ, জন-গণতান্ত্রিক উৎসবে মুখর।  

আমাদের মত মানুষের জীবন তো রোজকার টায়ারে হাওয়া ভরার মত। না হলে জীবন দৌড়ায় না। স্রোতস্বিনী মা গঙ্গার মতো কেউ যদি আমাদের মনকে তার নির্মল স্পর্শে ভরিয়ে তোলে, তবে আগামী দিনের পথ প্রশস্ত হয়।

আজ মনে হল, যে দিকে দুচোখ যায়  চলতে শুরু করি, তাই বেরিয়ে পড়লাম হারিয়ে যেতে। কোলাহল পূর্ন শহর-রাস্তা পেরিয়ে এক প্রান্তে উপস্থিত হলাম।  শহরের প্রান্তে বিরাট হাইড্রেন, শহরের যত আর্বজনা-জল বয়ে চলছে এই হাইড্রেন দিয়ে, আর গঙ্গায় গিয়ে মিশছে। মা গঙ্গা যে কত এই জল নিজের বুকে ধারণ করছেন কে জানে।  হয়তো নীলকন্ঠের মত কন্ঠে।  তাই তো স্রোতসিনী মা গঙ্গার জল এত স্বচ্ছ-পুণ্যের।

আরও অবাক হলাম, হাইড্রেনের উপর সিমেন্টের স্ল্যাব বিছিয়ে অসংখ্য ছোট ছোট দোকান গজিয়ে উঠেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় থেকে আরও অনেকে কিছু জিনিসের দোকান। জীবন চালাতে, জীবন সংগ্রামে ওরা নিয়োজিত। এই সভ্য শহরকে সবল-সতেজ রাখতে হাইড্রেনের অপর প্রান্তে, যতদূর চোখ যায়, নীড়া বস্তি। বস্তির প্রণম্য অধিবাসীগণ শহরের প্রত্যেক দিনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে দেন।  আবাসনের ঘরে ঘরে বাসন ধুয়ে দেন।  শহরের রাস্তা পরিষ্কার করেন। শহরবাসী নিশ্চিন্তে ঘুমান আর অন্য দিকে এদের অনিশ্চিত জীবনের ছায়ায় রাতের ঘুম পাতলা হয়ে আসে।  

রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। বস্তির কিছু ছেলে সাদা টলগুলি নিয়ে খেলা করছে।  আর একটু এগিয়ে ছোটো বাচ্চাগুলো দাওয়ায় বসে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে।  বক্সে গান বাজছে। এগিয়ে চললাম, কেমন যেন মাথা নিচু করে।  নিজেই নিজের মনের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলাম।  

জীবনের প্রকার ভেদ। তার মধ্যে আমরা মানুষ। কিলবিল করছি এক গহ্বরের মধ্যে।  কখনও কাঁদছি, চোখে জল, কখনও খিলখিলে হাসি। গহ্বরের ঢাকনা খুলল, আঃ আলো আর আলো। ঢাকনা বন্ধ, গুমোট অন্ধকার।  

মাথা উঁচু করতেই, একি দেখলাম…,পর পর প্রাণ সংহার….!  চার চারটে প্রান নিষ্প্রাণ, হাত-মাথা কাটা, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে মাটির বুকে। বুকের মধ্যে নিঃশব্দ কান্নায়, অথচ মুখে যেন চাপা হাসি।  

কিন্তু কেন…?

সবুজ পাতার স্নিগ্ধ ছায়ায় বুক ভরা নিঃশ্বাস…! একটু আরাম সহ্য হল না। রেল স্টেশনের সৌন্দর্যায়ণ প্রয়োজন। সেইজন্য তরতাজা প্রানগুলোকে বলি দিতে হল।  এখন স্টেশনে টিনের ছাদের আবরনে, গরমে যাত্রীদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম।  তাই চাপা হাসি হাসে হাত-মাথা কাটা গাছগুলো।  

চলতে চলতে স্টেশনের মুখে এসে পড়েছি বুঝলাম। ঘোষক ঘোষনা করছেন “এক্সপ্রেস ট্রেন থ্রু হয়ে যাবে, দূরত্ব বজায় রাখুন।” 

ওভার ব্রীজ দিয়ে নিত্যযাত্রী ওঠানামা করছে। এক নম্বর প্লাটফর্মে বহু যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, সময়ের অপেক্ষা। এখনই ঘোষনা হবে ট্রেন আসবার।  

অনতিদূরে চোখ পড়ে গেল। বেশ কিছু শতছিন্ন-বস্ত্র পরিধানরত মানুষ উসকো-খুসকো চুলে লাইনে দাঁড়িয়ে।  কৌতূহল হল এগিয়ে গেলাম। দেখি লাইনের অগ্রভাগে তিন-চারজন টাইপরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।  সামনে টেবিল পাতা, টেবিলে দু-তিনটে বড়-বড় ডেকচি।  একটা প্লাকার্ডও দেখলাম, লেখা ” কাঙালী ভোজন।” 

বারেবারে লাইন ভেঙে মানুষ ঐ ডেকচির দিকে নজর দেওয়ায় ধমকানি খাচ্ছে, “এই ঠিক করে লাইনে দাঁড়া নয়তো বার করে দেব।”  

আবার মনে পরে যাচ্ছে,”জীবন যেমন।”  এরাই হত-দরিদ্র ছিন্নমূল স্টেশনের বাসিন্দা।  সারাদিন চেয়ে চেয়ে খাওয়া, কেউ খেয়ে ঠোঁঙা ফেলে দিলে, যদি কিছু থাকে, খেতে লাগে বেশ। রাত্রে সিঁড়ির নিচে কিংবা স্টেশনের বসার ধাপিতে শোয়া।  মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে লাঠি চার্জ করে তাড়াতে চায় ওদের। সেই সময় স্টেশনের সারমেয় কুলই এদের সাথ দেয়, অন্য কেউ নয়।  

স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের কবিতা বলে…!

ভেবো না…,

আমরা স্টেশনে থাকি বলে

আমাদের কোন দাম নেই,

আমরা পথের কুকুরের মত

ভিখান্নে বাঁচি বলে,

আমাদের কোন দাম নেই।

আমরা যখন মরি

তখন কর্পোরেশন পাঁচশো টাকা পায়,

মাটিয়া কলেজ আমাদের লাশ

বিক্রি করে,

আমাদের জীবনের দাম নেই

আমাদের লাশের দাম আছে।।

ভাগ্যহীন খুর্দাতদের খিচুড়ি খাওয়া শুরু হয়ে গেছে।  আমাকেও বাড়ি ফিরতে হবে।

ক্রমশ…….

Author

  • ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়

    বর্ষীয়ান লেখক শ্রীযুক্ত ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৭ সালে পূর্ব বর্ধমান জেলার সাতগেছিয়া গ্রামে। বাল্যকাল কেটেছে ওখানেই। বিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করেন সাতগেছিয়া শ্রীধরপুর অবিনাশ ইনিস্টিটিউশনে ও পরবর্তীতে কালনা কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের পাঠ সম্পূর্ণ করেন। বর্তমানে হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় থাকেন। চাকুরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার পর এখন লেখালেখিতে অনেক বেশি সময় দিতে পারেন লেখক। লেখালেখি ছাড়াও তাঁর শখ ছবি আঁকা, গিটার বাজানো,যাত্রা থিয়েটার নাটকে অভিনয়, আবৃত্তি করা। একসময় ফুটবল খেলতেও ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর কথায়,"ছবি আঁকা, গিটার বাজানো, যাত্রা-থিয়েটার, নাটক-আবৃত্তি এই নিয়ে ব্যক্তি জীবন ছুটছিল কর্ম জীবনের সঙ্গে। কিন্তু নিখিলবঙ্গ সাহিত্য সন্মেলনের সঙ্গ পাওয়ার পর কেমন যেন হাতের আঙুল এগিয়ে এল কিছু লিখতে-বলতে। তখন থেকেই লেখার শুরু, যতটুকু পারি মনের ভাব প্রকাশ করি। এখন অবসরে অবশ্যই লিখছি। সার্থকতা সেখানেই যেখানে আমার লেখায় আনন্দ উপভোগ করবেন পাঠকবৃন্দ। সেই দিনটির কথা আমার মনে আছে, যেদিন কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার সময় নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন আমাকে সম্মান জানিয়েছিলেন। এখন যুক্ত হয়েছি নবতরু ই-পত্রিকার সঙ্গে। আশা করব নবতরু ই-পত্রিকার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হোক।"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

    গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

      আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

        মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন