জীবন যেমন(২য় পর্ব): ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন ।
উল্কা এপার্টমেন্ট, বিশ্বাস বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পৌঁছে গেলাম পি.সি.সেন লেনে। কিছু বাদেই বাড়ি পৌঁছালাম। প্রশ্নের মুখে দেরিতে আসার জন্য। আবার নানান প্রশ্নের আকড় নিজের মাথায় প্রবেশ করতে লাগল। “জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে, প্রশ্ন উঁকি মারে পথ বেয়ে।”
প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর কখনও কুল, কখনও কিনারা চেয়ে থাকে। অতীতের স্মৃতি সাঁতরে এসে বাসা বাঁধে মনের শিরা উপশিরায়। এক এক সময় মন স্মৃতির পাতায় অতীতকে ছুঁতে চায়। মনের দোরগোড়ায় বাল্য এসে খেলা করে, শৈশবকে নাড়া দেয়। অতি প্রিয়জনরা এসে ভিড় করে। এক একটি মুখ এক একটি আয়নায় পদার্পন করে, আমাকে পেতে চায়, কথা বলে। যেন একযুগ অতিক্রম করা সময় বন্ধনের হাওয়ায় সমীপবর্তী। বিস্মৃত হয় বর্তমান, জীবন যেখানে দণ্ডায়মান।
কিন্তু, ঐ যে, বাঁধা যায় না সময়। সময় গতিময়। আজ থেকে কাল…
কাল থেকে পরশু…পরশু থেকে
তরসু…সপ্তাহ….মাস….বছর… যুগ গড়িয়ে চলে সময়ের সাথে। জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানেই “জীবন যেমন।”
হারিয়ে গেছে শৈশব, ছোটো-বড়ো খুশির ডালা, বেড়েছে শুধু দায়িত্ববোধ। জানা যায় না ভবিষ্যৎ। জীবন মৃত্যুর মাঝে যে খেলা, খেলেই চলেছি অহরহ, দিন রাত্রি। কোথায় সমাপ্তি…? হয়তো অজানা সঙ্কেতে পথ বার বার হারিয়ে যায়। কখনও মেঘে ঢাকা, কখনো আলো মাখা।
বিশ্বাসবাবু বলেছিলেন, ছাদে উঠে শুকতারা দেখি কিনা। বিশ্বকবিকে মনে পড়ে যায়।
“আকাশ ভরা, সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে, আমি পেয়েছি মোর স্থান।”
সত্যি তো, ভেবে দেখেনি তো একবার! চিরাচরিত জীবন স্রোতের স্পন্দন তো এই পৃথিবীর পল্লী-শহরে…হাটে-বাজারে…ঝোপঝাড়ে, মাঠে-ময়দানে, অরণ্য-পর্বতে…জঙ্গলে। কিন্তু আঁধার রাতে, মাথার উপর, জ্বলজ্বলে নক্ষত্র ছায়াপথ, দপদপে সন্ধ্যাতারা, ব্রহ্মান্ড।
ভেবে দেখিনি তো এরা কারা? কোথায় এদের শেষ। এ কোন জগৎ!

এই অবোধ মনুষ্য জগতের সঙ্গে ঐ বিশাল আকাশ-গ্রহ তারার, ওই অনন্ত শূন্যের কী সম্পর্ক! সুদূর মরুভূমির মরীচিকায় জল যেমন মিথ্যা তেমনি মানুষের চোখে দেখা গ্রহ-তারার জগৎ ও মিথ্যা। যে জগৎকে প্রতিদিনের মাঠে-ঘাটে, কাজ কর্মে পাই, পৃথিবীতে তাই জীবন। জন-অরণ্যের কর্মব্যস্ত একঘেয়ে জীবনে যে সুখ-দু:খ আনন্দ আছে সেটাই পৃথিবীতে অনন্ত জীবনের ধারা।
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাখির ডাক, কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছিল। সূর্যালোকে শহর আস্তে আস্তে জেগে উঠেছে। হঠাৎ “কদম কদম বাড়াহে যা” ধ্বনি ও ব্যান্ডের আওয়াজে বিছানায় উঠে বসলাম। আজ তো আবার ২৬ জানুয়ারি। প্রজাতন্ত্র দিবস। স্কুলের ছেলে মেয়েরা তাই রাস্তায় বেরিয়েছে। তাড়াতাড়ি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গেলাম। স্কুলের ছেলেমেয়েরা লেফ্ট-রাইট করে প্যারেড করে যাচ্ছে। সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেল। এন্.সি.সি ক্যাডেট হয়ে, থ্রী-নড-থ্রী রাইফেল কাঁধে প্যারেডে যেতাম। কলেজের প্রিন্সিপাল গার্ড অফ অনার নিতেন। আরও কত উৎসব – আনন্দ হত! ১৯৫০ সালের এই দিনে আমাদের দেশ ভারত সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারনতন্ত্রে পরিনত হয়েছিল।
আজ ছুটির দিন। বাজারে রোজের কেনা-কাটা আছে। ভালোই হল, বাইরে অনেক চেনা মানুষের সাথে দেখা হবে তাই চা পান করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পরলাম। মুহূর্তে মার্কেট পৌঁছালাম। আজকে একটু অন্য চেহারা। চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, তেলেভাজার দোকানে বেশ ভিড়, জটলা। অনেকে ঝান্ডা নিয়ে, প্রভাতফেরি করে এখনও ঘুরছেন। দেখা হল নিহার এর সাথে।
-গুড মর্নিং নিহার ! কেমন আছো!
-আরে ব্যানার্জিদা যে, কী ব্যাপার? ২৬ জানুয়ারি পালন করলেন?
হঠাৎ এই রকম প্রশ্ন ছুটে আসবে বুঝতে পারিনি। একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কিছু বুঝে উত্তর দেবার আগেই পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দিল নিহার।
-কই, তে-রঙা নিয়ে প্রভাত ফেরিতে দেখলাম না তো?
-না…..না…. ঠিক, আসলে আজ ভোরে উঠতে পারিনি। আসছে বছর অবশ্য……!
একটু হন হন করে হাঁটতে লাগলাম। সবজি মার্কেট যেতে হবে। নানান ভাবনা ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সার্বভৌম, প্রজাতন্ত্র। এই শব্দগুলো যেন দুর্বোধ্য লাগতে লাগলো। হাঠে-বাজারে,মাঠে-ঘাটে,রাস্তায় কাতারে কাতারে মানুষ দেখছি,সবাই কি আজ ঝান্ডা নিয়ে প্রভাত ফেরি করেছে ! নিশ্চয় নয়। অটোওলা, ঠেলাওলা, কাজের মানুষ সবাই তাদের জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেটে প্রতিনিয়ত পয়সা রোজকার করলেই এদের পরিবার দু-মুঠো খেতে পাবে।
কখন যে সবজি মার্কেটে ঢুকে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ…
-বাবু, বেগুন নেবেন? ভালো বেগুন, দেখুন না…..
ঘুরে দাঁড়ালাম।
-কত করে দিচ্ছ?
-আজ্ঞে কুড়ি টাকা কিলো? নিয়ে যান ভালো বেগুন। আজ বাজারে পঁচিশ টাকা যাচ্ছে। আমি একটু সস্তায় দিয়ে দিচ্ছি।
-কেন? সস্তা কেন…..?
-বাবু সব মাল বিক্রি করে যেতে হবে। না হলে চাল-ডাল তেল-নুন এর কি হবে…..! তাছাড়া আজ খদ্দেরও কম।
হাঁটু গেড়ে, নিচু হয়ে বসে বেগুন বাছতে লাগলাম।
-দাও দু-কেজি দাও।
-আচ্ছা বাবু……..!
বেগুনওলার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চোখ ঢুকে গেছে, হাত-মুখ, শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে। কৌতূহল হল…..!
-আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ভাই?
-এ্যা………
-বলি যদি কিছু মনে না করো একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?
-এ্যাজ্ঞে……….!
-তোমার বয়স কত?
-হ্যে….হ্যে……হ্যে……..এজ্ঞে আশি ছুঁই ছুঁই হবে………!
-আশি ছুঁই- ছুঁই? এই বয়সে সবজি মাথায় বয়ে বাজারে বিক্রি করো?
-কী করবো বাবু! দিন চলবে কী করে!
-তোমার ছেলে মেয়েরা নেই?
-হ্যে…….হ্যে……..হ্যে…..তারা তাদের সংসার নিয়ে আছে বাবু।
আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ…….
-আচ্ছা তোমার কাঁধে ব্যথা হয় না এত ভারি জিনিস বইলে?
-এ্যজ্ঞে……রসুন তেল দিয়ে ডলে দিলে ব্যাথা চলে যায়।
হতবাক হয়ে বেগুনওলার দিকে চেয়ে থাকলাম। পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-এই নাও ভাই টাকাটা।
-এই নিন বাবু দশ টাকা ফেরৎ।
-না……না….. আজকের যা রেট তোমাকে তাই নিতে হবে।
বলে চলে এলাম।
মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন! আরও কত আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এই ভাবে দিন গুজরান করছেন কে জানে! আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়, ভিখারি হয়ে নয়। স্বাধীনোত্তর ভারতে এরাই কি তবে ভারতবর্ষ?
তাড়াতাড়ি আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির পথে রওনা হলাম। চলতে চলতে রাস্তার পাশে সি.এ. মাঠ। কিছু ভাষণ কানে এল।
“বন্ধুগণ….এ বছর এক কোটি যুবক-যুবতীর কর্ম-নিয়োগ হবে। সরকার এর লক্ষ্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান।”
কেমন যেন ঘোরের মধ্যে এসে গেলাম। পথ চলতে লাগলাম। ইসরো আর কিছুদিনের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠাবে। ডি.আর.ডি.ও এমন একটা অস্ত্র তৈরি করেছে, সারা দুনিয়া ভয়ে কাঁপছে। ভারত আগামী দিনে বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে দেখা দেবে।
কী জানি কী হবে…..!
অদূরেই সুভাষ বোসের মূর্তির ওপর কতকগুলি কাক একটা মরা ইঁদুর নিয়ে মারামারি করছে।
কতক্ষণ যে পি.সি.সেন লেনের আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি খেয়াল হয় নি।
বাস্তব চিত্র খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে আপনার লেখায়।ধন্যবাদ জানাই।