জীবন যেমন(চতুর্থ পর্ব): ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
শরতের হঠাৎ হঠাৎ ধূসর মেঘে ঝমঝম বৃষ্টি আসে, আবার পলকেই ঝলমলে রোদ ওঠে। দূরের আকাশে কালো মেঘ ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। ফুরফুরে হাওয়ায় ধবধবে সাদা কাশবনে দোলা লাগে। আবার আঁধার রাতে ফুটফুটে জ্যোৎস্না হাতছানি দেয়।
আমাদের জীবনে আগত দুই অনুভূতি নাড়া দেয়। এক সুখ পাওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে যন্ত্রনার দুঃখ-কান্না। এগুলো কোনোটাই রাস্তায় পড়ে থাকে না। আমরা আনয়ন করি। জীবনকে সহজ করার জন্য যে কর্মযজ্ঞে অবতীর্ণ হই, দেখা যায় সামনেই কঠিন পথ, তাই সুযোগের অপেক্ষায় প্রার্থনা করি। অন্যায় মনে, ক্ষমার ভানে এড়িয়ে চলা। কিন্তু জীবন দর্শন কি বলে…! খুশি…আর খুশি, সে যে রাস্তায় হোক, যে মত যে পথ হোক। উন্মুক্ত আকাশে উড়ে চলা। কঠিন দাপুটে বাতাস অগ্রাহ্য করা। কবিতায় বলে…!
এত হাসি এত সুখ, পেয়েছে জীবনের মুখ,
উড়ে চলে আকাশে, পাখা মেলে বাতাসে,
মেঘের আড়ালে কথা, নীড়ে বসে যত ব্যথা,
অনুভুতি নাড়া দেয়, সুখ-দুঃখ আনন্দ,
পলকেই কঠিন পথ, কর্মযজ্ঞে অবতীর্ণ,
ধূসর মেঘ গমগম, বৃষ্টি আসে ঝমঝম,
ফুরফুরে ধবধবে কাশবনের দোলা,
আঁধার কাটে, জ্যোৎস্না আসে,
স্নিগ্ধ আলোয় ভরা,
সুখ রহে পথে পড়ে, নিতে হয় হাতে গড়ে,
জীবন দর্শনে আসা, যত ভালবাসা।
জীবন যেন কত কিছু তাই না…! অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এর মধ্যে জীবন যেমনই বর্তমান। ছোট্ট ছোট্ট আশা নিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন। জীবন চলতে সৃষ্টি হয় অনেক দিক, পরিবার বন্ধু-বান্ধব, দয়া-সততা, এর মাঝে খেলা করে ভালবাসা। ভালবাসা সর্বোপরি নিজেকে, সংসার-সমাজ-দেশ আরও কত কিছুকে। চলতে চলতে নেমে হঠাৎ নেমে আসে তীব্র গতির গ্রহাণু। কখনও পাশ কাটিয়ে যায়, কখনও আঘাত হেনে জীবন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।

তাই তো বলি, ‘জীবন’…তুমি একটু ধীরে চলো না…! আরও বেশ কিছুদিন “জীবন যেমন” তোমার সাথে কাটানোর ইচ্ছা। আরও যেন মনে হয় অনেক কিছু বাকি। সূর্যালোকে সামনের পথ আলোয় ভরা, অন্ধকারে কষ্টযাপন। বইতে হয় ব্যথার ভার দহন জ্বালা।
যদি এক্কেবারে হারিয়ে যাই, যদি ফুরিয়ে যায় ফাগুন বেলা, হয়ত আমার মূল্যবোধ অনেকের কাছে দামি হয়ে থাকবে। জীবন মানেই তো এক বাস্তব ছবি। স্বপ্ন নিয়ে খেলা, আবার স্বপ্ন ভাঙা।
সাত সকালে ঘুম ভেঙে দেখি, প্রখর রোদ্দুরের তেজ। এক মুঠো লাল পলাশের কোনও খবর নেই। নীল আকাশে টুকরো টুকরো কালো মেঘ জড়ো হচ্ছে। তবে কি বৃষ্টি-বৃষ্টি-বৃষ্টি সেই কোন অপরুপ সৃষ্টি? এক ঝাঁক সাদা ধবধবে বকের সারি কালো ধূসর মেঘের নিচে। হয়ত সন্ধ্যা নেমেছে বাড়ি ফিরতে হবে। হঠাৎ মেঘ ফাঁক হয়ে আগুনের ফুলকি। সঙ্গে গর্জন কড়াত…কড়াত। সত্যি গর্জনে-বর্ষনে সোঁদা গন্ধ। একটা টুল নিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম। নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা, কখনও আকাশের দিকে, কখনও এদিক-ওদিক। তীব্র গতির সোঁ-সোঁ আওয়াজ। গাছের পাতা উড়িয়ে আকাশের ঘূর্ণি এদিকেই ধেয়ে আসছে। বিশাল বস্তা কাঁধে কাগজ কুড়ুতে মধ্যবয়সি আশ্রয়ের সন্ধানে। স্ত্রী তার অসুস্থ স্বামীকে হাঁটাতে নিয়ে এসে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে। বৃষ্টি আসল ঝমঝম। আকাশের কি আসে যায়, সে তার ঝাঁপি খুলতে ব্যস্ত।
বুক ভরে নেওয়া টাটকা বাতাস। গায়ে লাগে বৃষ্টির ঝাপটা। দূর আকাশে বৃষ্টির লাইন গতিতে মাটির বুকে। রাস্তা টইটম্বুর জলে ভাসছে, যেন নদীর স্রোত।
বেশ কিছুক্ষণ বসে ব্যালকনিতে। ধীরে ধীরে বৃষ্টির ধারা কমে আসছে। মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ফাঁকে নীলাকাশ। সাদা বকের দল পুনরায় উড্ডীয়মান। গাছের পাতায় লুকিয়ে থাকা পক্ষীকুল সরব হয়ে উঠেছে। রাস্তায় নেমেছে আবার ব্যস্ত মানুষ। আমিও উঠে পড়লাম।
আজ মনে হল গঙ্গার এপারে বহুদিন হয়ে গেল, একবার নৌকায় ভেসে ওপারে গেলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তৈরি হয়ে আবাসন থেকে মাটিতে নেমে পড়লাম। রাস্তায় হেঁটে চলেছি। অনতিদূরে জিটি রোড। রোডের ওপারেই খেয়াঘাট। তাড়াতাড়ি কাউন্টার থেকে পারাপারের টিকিট কেটে নামতে যাবো…,”বাবু… কিছু দিন-কিছু দিয়ে যান।” এক সঙ্গে অনেক জন বলে উঠলো। চেয়ে দেখি প্রত্যেক ধাপিতেই একজন করে বসে।
পকেটে মানিব্যাগ, পয়সা আছে তো…, হ্যাঁ আছে। সব ধাপিতে যা হাতে উঠল দিয়ে গেলাম। শেষ ধাপিতেও দিলাম। নামতে যাব…মানুষটি বলে উঠলো….
বাবা…তিন টাকা ফেরৎ…!
ফেরৎ…এ আবার কি!
বাবা… পাঁচ টাকা দেছেন, তাই তিন টাকা ফেরৎ।
হাসি না কান্না পাবে, কিছু বোঝার আগে হাত নেড়ে বললাম, পাঁচ টাকার কয়েন তোমার…ফেরৎ নয়।
হনহন করে পাটাতন দিয়ে নৌকায় এসে বসলাম। নয়তো খেয়া ছেড়ে দিলে আবার অপেক্ষা করতে হবে।
একবার ঐ শেষ ধাপির মুমূর্ষু ,অসহায় ভিখান্নে বাঁচা মানুষটির দিকে তাকালাম, দেখি আমার দিকেই চোখ ফিরে আছে। কি ভাবছে কে জানে!
আমি এখন মাঝ গঙ্গায়। খেয়া বয়ে চলেছে। চারিদিকে শুধু জল আর জল। আর গঙ্গার নির্মল স্রোত। গঙ্গা সেই গো-মুখ হিমবাহ থেকে কত জনপদ পেরিয়ে সাগর অভিমুখে। কিন্তু বিস্তীর্ণ দু-পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকারই বেদনা দেয়।