জন্মদিনের পায়েস—ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
সুবর্ণরেখা ও খরকাই-এর সঙ্গমস্থল তীরবর্তী অঞ্চল গাছ গাছালিতে ভরা। টাটা কোম্পানির পক্ষ থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত করাতে মানুষের আনাগোনা বিশেষ নেই। হয়ত সেইজন্য পক্ষীকুল এখানে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। তানে- গানে মশগুল তারা, অবাধ বিচরণ। উড়ে চলে যেখানে খুশি, ডানা ঝাপটায় নদীর জলে। এখানে নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারা প্রবেশকালে নিজের নাম-ধাম ফোন নম্বর ইত্যাদি নথিভুক্ত করাতে হয়। ফেরার সময় ‘এন্ট্রি-ক্লোজ’ করে বাইরে আসতে হয়।

এইখানেই নদী সঙ্গম তীরবর্তী স্থলে এক মা একদিন একটি গাছের নীচে বসে ছিলেন। উদভ্রান্ত যেন, দৃষ্টি স্রোতস্বিনী নদীতে। আত্মার সঙ্গে আত্মীয়র যোগ ছিন্ন হলেও, মনের কষ্ট আর চোখের জল কি সকলকে দেখানো যায়! আর দেখালেই বা হবে কি! কেউ তো আর কারও কষ্টের ভাগ নিতে যাবেন না। চোখের ভাষায় নদীকে কিছু প্রশ্নও ছুঁড়ছেন। কিন্তু নদী তার প্রবাহে ব্যস্ত। অতি বাস্তবতায় তার সবকিছু আশা-নিরাশা, বিন্দু বিন্দু ভালবাসা একাকার হয়ে পড়েছে। কিছু হারিয়ে গেলেই কি সব কিছু শেষ হয়ে যায়! ফেলে আসা জীবনই সম্পূর্ণ ইতিহাস হয়ে বুকে বেঁধে চোখের সামনে ভাসে। চোখের জল সময়ে সময়ে বাধার শৃঙ্গ পেরিয়ে ঝর্না হয়ে বেরিয়ে পড়তে চায়। সবার মাঝে তাকে পাথর চাপা দিতে হয়, বাঁধ দিয়ে আটকে দিতে হয়। একান্তে তাকে ছাড়তে হয়।
মায়ের মন ও হৃদয় তোলপাড় করছে এই সব কথা ভেবে। আর বিলম্ব করা চলবে না। এইবার শেষের কাজটি সেরে রওনা হতে হবে বাড়ির পথে।
হিতেন্দ্র সোনারী থেকে আসছেন। সিকিউরিটি গেটে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে তড়তড় করে নামছেন, তিনিও নদীতে স্নান করবেন। একবার নদীর পথে চোখ পড়ল, গাছের নীচে মহিলার দিকে। স্নান সেরে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে বাড়িতে।
দেহ মন সিক্ত করে হিতেন্দ্র উঠে আসছিলেন। পুনরায় ঐ মহিলার দিকে চোখ পড়তেই আশ্চর্য হলেন। মনে মনে বললেন, “না…… একবার জিজ্ঞাসা করেই দেখি কী ব্যাপার!”
-“আপনি এই নির্জন জায়গায় বসে কেন মা?”
মা-ডাক শুনে মহিলা যেন চমকে উঠলেন। -“না….না…. এমনি বসে আছি।”
-“তাই হয় কখনও। নিশ্চয়ই আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে। একভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন লক্ষ্য করছি। আপনার বাড়ি কোথায়? চলুন বাড়ি চলুন!”
মহিলা ভাবছেন, যে উদ্দেশ্যে আজকের দিনে এখানে আসেন, পায়েস রান্না করে নদীতে ভাসান, তা আর হল না। ছেলেটি মা বলে ডেকেছে, এক দারুন অনুভূতি, অনেকদিন পর মা-ডাক শুনে। ‘আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না…..’- ভেবে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন।
-“কী ভাবছেন মা?”
-“না…. না… বাবা, বলছিলাম কি… তোমার বাড়িতে আধঘণ্টার জন্য আমাকে নিয়ে যাবে! আধঘণ্টার বেশি এক সেকেন্ডও থাকব না।”
-“আমাদের বাড়িতে?”
অপরিচিত মহিলা কে বাড়িতে নিয়ে গেলে স্ত্রী বা কী ভাববেন? তাছাড়া কেনই বা নিয়ে যাবেন? নিয়ে গিয়ে অন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না তো? সাত পাঁচ ভাবছেন হিতেন্দ্র।
-“জানি বাবা, তোমার সন্দেহ হচ্ছে অপরিচিতকে নিয়ে। ভেবো না ,আমি চোর- ডাকাত নই। কোনো চিন্তা নেই। একটু কাজ, আমার কাছে আতপ চাল, দুধ, চিনি ও কাজু-কিসমিস সব আছে। পায়েস রান্না করে তোমায় খাওয়াব। তারপর চলে যাব, আর কোনো দিন ফিরে আসব না।”
-“পায়েস রান্না করে খাওয়াবেন আমাকে? কিন্তু কেন?”
-“এই ছোট্ট অনুরোধটুকু রাখবে না বাবা?”
-“না…… তবে….”
-“তবে নয় বাবা…. এইটুকু সুযোগ আমাকে দাও বাবা। কৃতজ্ঞ থাকব তোমাদের কাছে।”
-“আচ্ছা চলুন।”
বাড়ি এসে হীতেন্দ্র সব কিছু খুলে বললেন তার স্ত্রীকে। স্ত্রী প্রথমে নিমরাজি হলেও পরে একটা শর্তে রাজি হলেন, বললেন, “আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকব এবং সব দেখব।”
মহিলা বললেন, “তাই হবে মা…… ।”
অবশেষে মহিলা পায়েস রেঁধে, বাটি হিতেন্দ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “খাও বাবা….. ততক্ষণে আমাকে একটা কাগজ পেন দেবে?”
-“হ্যাঁ দিচ্ছি”
মহিলা কাগজ কলম নিয়ে কিছু লিখতে লাগলেন। লেখা শেষ হলে হিতেন্দ্রর হাতে দিয়ে বললেন, “এই বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে গেলে এই চিঠিটা প’ড়ো বাবা।” এই বলে মহিলা চলে গেলেন।
অতঃপর হিতেন্দ্র চিঠি পড়তে আরম্ভ করলেন।
-“আমি তোমার নাম জানি না বাবা, আজ নদীতীরে হঠাৎ তুমি আমাকে ‘ মা ‘ বলে ডেকেছিলে এইজন্য তোমায় ছেলে বলেই সম্বোধন করলাম। তোমাদের কিছুক্ষণ বিরক্ত করেছি তারজন্য কিছু মনে কোরোনা বাবা। আজ আমার বিশেষ দিন, আমার ছেলের জন্মদিন। এই দিনেই প্রত্যেক বছর নদীতে গিয়ে মাটির গামলায় পায়েস রেঁধে নদীর জলে ভাসিয়ে দিই আমার ছেলে খাবে বলে। কেন জান বাবা…..! কিছু বছর আগে খরকাই- সুবর্ণরেখা আমার ছেলেকে সেই যে ডেকে নিল, আর ফিরিয়ে দিল না। আজ তোমার মা ডাক শুনে মনে হল, পায়েস রান্না করে তোমায় খাওয়ালেই আমার ছেলেকে খাওয়ানো হবে ।
অনেক অনেক শুভকামনা রইল। আশীর্বাদ নিও।
ইতি-
অনিতা পাকড়াশী
প্রাক্তন অধ্যাপিকা(অর্থনীতি বিভাগ)
গ্র্যাজুয়েট কলেজ সাকচি
জামশেদপুর-৬