দেখতে দেখতে কত গ্রীষ্ম কত বসন্ত, শরৎ গেছে কেটে। ফেলে আসা শৈশবের কত স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে।
আজ উষ্ণায়ণের যুগে এসে দাঁড়িয়েছি। কী ভীষণ প্রচন্ড গরম! আজ তো জীবন নিয়ে টানাটানি। প্রাণ ওষ্ঠাগত।
কিন্তু ছিল তো একটা সময়? প্রতিটি ঋতু পরিবর্তন একেক'টা আলাদা সুখকর অনুভূতি জড়িয়ে থাকত। ভাবিনি কখনো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের অনিবার্য আবশ্যিকতার।
মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম এনে দিত ঘনিয়ে আসা কালবৈশাখী! চারিদিকে অন্ধকার করে আসলেও মনে ছিল না কোনো ভয় ডর। সন্ধের সময় ভাইবোন সবাই মিলে একসাথে পড়তে বসা। মায়ের হাতে তালপাতার পাখার বাতাস। প্রচন্ড দাবদাহে পাড়ার ধারে কাছে ছোট ছোট জলাশয়গুলোর জল প্রায় শুকিয়ে আসতো। ছোট থেকেই ছিলাম ভীষণ ডানপিটে। পাড়ার সব ছেলেরাই ছিল আমার বন্ধু। রবিবার ছুটির দিনে দলবেঁধে নেমে পড়তাম ওই ডোবার মধ্যে হাত দিয়ে মাছ ধরতে। সর্বাঙ্গে কাদায় মাখামাখি। চলে যেতাম বাড়ির পাশেই চাষের জমির আলে। যেখানে পাম্পের সাহায্যে জল দেওয়া হত ধান মরসুমি খেতে। চওড়া জমির আল দিয়ে স্রোতের বেগে ছড়িয়ে পড়তো জল বিভিন্ন দিকে, সমবয়সী আমরা সবাই ওই আলে গা ভাসিয়ে থাকতাম বহুক্ষণ সময় ধরে। দুপুর নিঝুম হলেই মায়ের পাশ থেকে নীরবে উঠে বেরিয়ে পড়তাম দলবল সঙ্গীসাথীদের একাট্টা করে, পাড়ার যত আমবাগান ছিলো সেই আম গাছের নিচে। কেউ গাছে উঠে পড়ত, তো কেউ আম কুড়োত। বাড়ির লোকেরা সজাগ হতেই তারা করতে এগিয়ে আসত। পাঁচিল ডিঙিয়ে পড়ি কি মরি ছুট। কেউ আবার ধরা পড়লে কানমলা, উঠবস, বাবার কাছে নালিশ। পিঠে উত্তম মধ্যম চড়-চাপড়। কখন রাস্তায় পড়ে হাত-পা ছরে রক্তপাত। আশেপাশের কচুর ডাটির কষ লাগিয়ে নিতাম। ডাকাতপাতা বলে ছোট ছোট পাতার ভরা একধরণের গাছ ছিল সেই গাছের রস লাগালে রক্ত বন্ধ হয়ে যেত। ব্যাথা হাওয়া এতো কিছুই কি আর বাড়ির বড়রা জানত? কখনো-সখনো মায়ের চোখ পরে গেলে তখন বলতে হত কী করে হল। বেশিরভাগ বাড়িতেই কেরোসিন তেলে আলো জ্বলত। সেভাবে তখনও বৈদুতিক আলো আসেনি ঘরে ঘরে। ছিল না দশ'পা দূরত্বে একটা করে ল্যাম্পপোস্ট, ঘরে ঘরে ছিল না বৈদুতিক পাখা, আর বিজলি বাতির আধিক্য। সেসবের প্রশ্নই ওঠে না। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে সবে সেজে উঠছে আলোর রোশনাই। ওই থেকেই পাড়ার অলিগলিতে আলো ঠিকরে পড়ে যতটুকু পাড়া আলোকিত। পড়া শেষ করে ছোট বড় সকলেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়তাম গাছের হাওয়ায় শরীর ঠান্ডা করে নিতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেই আজ থেকে চল্লিশ বছরের পরিবেশ ছিল গা ছমছম করা। ঘরের মেয়েরা প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখতে পারত না। পরিবারেরও ছিলো কঠোর অনুশাসন।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে দেখিনি গরমে প্রাণ ওষ্টাগত ত্রাহি ত্রাহি পরিণতি। হাত পাখার বাতাস, সেও মায়ের ঘুমজাগা যত্ন আর আমাদের শান্তির ঘুম। বয়ঃসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা দিদির মন চাইলেও এমন উদ্যোমে অংশ নিতে পারত না। ছোট ভাইবোনদের আনন্দে সামিল থাকত। কালবৈশাখীর দাপটকে বইয়ে দিতে একটু বৃষ্টি আনতে বরুণ দেবতার উদ্দেশ্যে পিঁড়ি উঠোনে ছুঁড়ে দিতেন মা-জেঠিমারা। গলোবস্ত্র হয়ে হাত জোর করে প্রার্থনা করতেন কায়মনে। আজকের দিনে কুসংস্কার হলেও সেদিন ছিলো অন্ধবিশ্বাস। নামত বৃষ্টি সাথে শিলাবৃষ্টি। মত্ত হয়ে পড়তাম ওই শিল বরফে। গ্লাসে বাটিতে কুড়িয়ে নিয়ে চিনি মিশিয়ে বরফগোলা খেতাম মনের আনন্দে।
সেকাল আর একালের জমিন আসমান ফারাক হয়ে গেছে। আজকের ছেলেমেয়েদের এই কংক্রিটের দুনিয়ায় আর তা উপভোগ করা হল না। গ্রামবাংলায় এখনো অল্প বিস্তর যদিও দেখা যায় মেট্রো শহর আজ সবুজহীন। শিশুরা পর্যন্ত এইসব থেকে বঞ্চিত। এযুগের শৈশব সবটাই ডিজিটাল আর ভার্চুয়াল।
শৈশব আজ বড়ই ফ্যাকাশে।
আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে
শীত বুড়ির চাদর পেড়িয়ে যখন গ্রীষ্মকাল আসে দাবদাহ যেন ভৈরব সন্ন্যাসীর মতন তাড়া করে। আমাদের ছোটবেলায় মুঠোফোন অনেক দূরের ব্যাপার লোডশেডিং এর পাড়ায় কার্টুন দেখাও ছিল শক্ত কাজ।