প্রাচীনগন্ধী স্মৃতিপূর্ণ চিলেকোঠার মতো আমেজ এই ছোট্ট বইটিতে! সুদূর কলাপোতার কুয়াশাভরা শিউলিতলার মিঠে ওম, ঘরছাড়া প্রবাসীর মনখারাপের হৃদয়বেদনা আর হঠাৎ বাঙালির দুর্গোৎসবের আনন্দ মেশানো, সরষে ফুলের মধুর মত এক উপন্যাস ইন্দুবালা ভাতের হোটেল! এ এক বাঙাল-ঘটির রান্না-গেরস্থালি-সংসারের স্মৃতিমেদুর উপাখ্যান। ইন্দুবালার হোটেলের খাওয়ার ঘরে মিশে গেছে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলা, বাঙালের চুইঝাল থেকে ঘটির মালাইকারি। পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করলে গন্ধ পাওয়া যায় নারকোল দিয়ে কচুবাঁটা, আমতেল দিয়ে সরলপুঁটির ঝোল আর কচি আমড়ার টকের। মুখে আসে বিউলির ডাল আর আলুপোস্তর স্বাদ। ইতালির বাগানে আসে খুলনার এক অখ্যাত গ্রামের শেষবিকেলের আমবাগানের মৌতাত। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিহারের কমলানদীতীরের সেই লছমীর লিট্টির চাটনির টক-ঝাল-মিষ্টির স্বাদ পাওয়া যায়। পড়তে পড়তে চলে যাওয়া যায় কলাপোতার সেই পুকুরপাড়টিতে, যেখানে ভেসে উঠেছিল পূর্ণতা না পাওয়া স্বর্ণলতার প্রেমের মৃতদেহ।

ভেসে আসে মনিরুলের হালকা বাঁশির সুর। গোধূলির অস্তরাঙা সূর্যের মলিন আলোয় মিশে যায় গ্রামের পথ আর কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের বাড়ি। কৃষ্ণনগরের ফিজিক্সের প্রফেসর ঝন্টু গল্প শোনায় এইট্টিজ়ের। ঘোরের মতো আসে সত্তরের কালবেলার আঁচ, কয়লার উনুনের তাতে মিশে যায় নকশাল অলোকের ফিসফিসে কথা, ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই, কিন্তু বিশ্বাস করে আপনি আছেন তাই আমরা আছি। ওড়িশার কোন অজ গ্রামের ছেলে, বুড়ো ধনঞ্জয় গজগজ করে মেসবাড়ির ছেলের দলের হুটোপাটিতে, পরক্ষণেই পরম স্নেহে ডেকে ডেকে খেতে বসায়। বিদেশফেরত সুনয়নীর স্বাদকোরকে ছাপ পড়ে কুমড়ো ফুলের মিঠে বড়ার। চুইঝালের গন্ধ, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোলের ভাপে মেতে ওঠে সারা পাড়া।
বাংলাদেশের হেঁসেলের একাল-সেকালের আখ্যানে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিচিত্র-জীবনানন্দের বঙ্গপ্রেম মিশে রস গড়ায়। কল্লোলবাবুর কলমের মুন্সিয়ানার ছাপ এ উপন্যাসের পরতে পরতে।