কেরিয়ার গাইড(২য় পর্ব): – অংশুমান বন্দ্যোপাধ্যায়
(প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
৩। ডিজিটাল/ ভিডিও গেমিং (গেমার/ ডেভেলপার/ ডিজ়াইনার)
ডিজিটাল/ ভিডিও/ ভার্চুয়াল গেমিংকে বেশিরভাগ ভারতীয় বাবা-মা-ই সময় নষ্ট বা বিনোদনমূলক ব্যাপার হিসাবেই দেখেন। কিন্তু এই বিষয়েও কেরিয়ার গড়া সম্ভব।
কখনও কি ভেবেছেন যে চারপাশে এত গেম, সে-সব তৈরি করেন কারা? কেনই বা তারা তৈরি করেন? তৈরি করে তারা কী পান? সামান্য একটা তথ্য দিই, ২০২০ সালে শুধু ভারতের গেমিং মার্কেট ভ্যালু প্রায় ৯০ বিলিয়ন রুপি (১ বিলিয়ন=একশো কোটি) এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে যে ২০২২ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪৩ বিলিয়ন রুপি এবং শুধু আমেরিকায় ২০২০ সালের শেষে এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা লোকের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ এবং ২০২০ থেকে ২০২১-এ সেই সংখ্যা ন্যূনতম ৫-১০% বাড়বে বলে জানাচ্ছেন পরিসংখ্যানবিদরা। বুঝতেই পারছেন, স্রেফ সময় নষ্ট বা বিনোদনের ব্যাপার নয়। যদি সত্যিই চান গেমিংকে নিজের কেরিয়ারে পরিণত করতে, তাহলে আপনার রাস্তা হতে পারে মূলত তিনটি:—
১) গেমার—যারা গেম তৈরির পর তা খেলেন এবং মতামত দেন,
২) ডেভেলপার— যারা গেমের পেছনের কোডিং করেন,
৩) ডিজ়াইনার—যারা গেমের গল্প তৈরি করেন এবং গেমটি এবং তার সবকিছু (চরিত্ররা, পরিবেশ, অন্যান্য বিষয়বস্তু) কেমন দেখতে হবে বা কী হবে তা ঠিক করেন।
১) গেমার হতে গেলে আপনাকে গেমিং-এর উপর ডিপ্লোমা নেওয়ার পর চেষ্টা করতে হবে কোনও গেমিং স্টুডিওতে গেমার হিসেবে যোগ দেওয়ার; অথবা নিজস্বভাবে গেম খেলে আপনার মতামত এবং গেমটি উন্নত করবার উপায় জানাতে হবে। কিছু গুণ বা দক্ষতা যেমন ধৈর্য বা মনোযোগ না থাকলে এই বিভাগে উন্নতি সম্ভব নয়। কিছুদিন লেগে থাকলে এবং গেম উন্নতির যথাযথ উপায় বাতলাতে পারলে গেমার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
২) গেম ডেভেলপার হওয়া আসলে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হওয়াই প্রায়। কিছু বিশেষ সফটওয়্যার জানা এবং কোডিং করার ক্ষমতা থাকলেই আপনি গেম ডেভেলপার হতে পারেন। আজকাল ইউটিউবেই দেখতে পাবেন কী করে সাধারন গেম তৈরি করা যায়। বিশেষ দক্ষতা অর্জনে এবং নিজেকে বাকিদের থেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে শিখুন; গেমিং ইঞ্জিন, যেমন আনরিয়াল, ফ্রস্টবাইট, ইউনিটি, গো-ডট, বা ক্রাই-ইঞ্জিন।
৩) ডিজ়াইনার- গেম ডিজ়াইনার হতে গেলে আপনার ছবি আঁকার দক্ষতা এবং সুনিপুণ কল্পনাশক্তি থাকা অত্যাবশ্যকীয়। প্রথমে একটি গল্প তৈরির পর হাতে এবং কম্পিউটার/ট্যাবলেটে ছবি এঁকে ডিজ়াইনাররা গেমের বিভিন্ন দিক যেমন চরিত্ররসমূহ, পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়বস্তু তৈরি করেন। এই বিভাগে অ্যানিমেশন জানাও বিশেষ জরুরি।
কিছু বড় গেম তৈরির প্রতিষ্ঠান বা গেমিং স্টুডিয়ো- নিন্টেন্ডো, উবিসফট, সোনি, ইএ বা ইলেক্ট্রোনিক আর্টস, এপিক গেমস, অ্যাক্টিভিশন, স্কোয়ার এনিক্স, গেমলফট।
সংক্ষেপ–
ন্যূনতম যোগ্যতা- দ্বাদশ শ্রেণী পাস, পড়াশোনা- গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স বা ডিপ্লোমা, চাকরির সুযোগ- পরিসংখ্যান থেকেই বুঝতে পারছেন এই বিভাগে কী পরিমাণ সুযোগ। ভবিষ্যতে এর সংখ্যা আরও বাড়বে।
মনে রাখবেন- ডেভেলপার হতে সেরকম কিছু দক্ষতা আগে থেকে থাকার দরকার না-হলেও, গেমার/ডিজ়াইনার হতে কিছু দক্ষতা আগে থেকেই থাকা দরকার।
৪। আইওটি বা ইন্টারনেট অফ থিংস
আইওটি জিনিসটি আপনারা সবাই দেখেছেন, বা ব্যবহার ও করেন হয়ত, কিন্তু হতে পারে এই শব্দবন্ধটির সাথে পরিচয় নেই। মনে করুন, কখনও কি দেখেছেন হাততালি দিয়ে পাখা চালানো/বন্ধ করা বা আলো জ্বালানো/বন্ধ করা? এগুলি আইওটির খুব সাধারণ উদাহরণ। বিজ্ঞানের যে পরিমাণ অগ্রগতি হচ্ছে, কিছুদিন পর শরীর না-নড়িয়েই আমরা সমস্ত কাজ করতে পারব। সমস্ত জড়-পদার্থ যেমন আলো-পাখা-দরজা-জানালা-খাট-আলমারি-রান্নাঘরের আসবাবপত্র যদি দূর থেকেই আমাদের ভাষা বা ইঙ্গিত বুঝতে পারে, তাহলে এটা খুব সাধারণভাবেই সম্ভব। এবার জড় পদার্থের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের জন্য দরকার কিছু জিনিস, জার মধ্যে প্রধান হল ১। কিছু সেন্সর, যা আমাদের ভাষা, ইঙ্গিত বা স্পর্শকে দেখতে, শুনতে বা বুঝতে পারবে, ২। একটি সফটওয়্যার বা অ্যালগরিথম যা আমাদের ভাষা/ইঙ্গিত/স্পর্শের মাধ্যমে (সেন্সরের বোঝার মাধ্যমে) আমাদের নির্দেশ বুঝতে পারবে এবং নির্দেশমতো জড় বস্তুটির বিভিন্ন অংশের মাধ্যমে কাজটি সম্পূর্ণ করবে। ৩। জড় বস্তুটিতে লাগানো কিছু বিশেষ যন্ত্রাংশ, যা অ্যালগরিথমের নির্দেশমতো তথ্য আদানপ্রদান এবং সেই তথ্য ও নির্দেশমতো কাজ করতে সক্ষম। ধরুন আপনার ঘরের ফ্যানটি আইওটির মাধ্যমে সংযুক্ত করা হল। অ্যালগরিথমকে নির্দেশ দেওয়া হল একবার হাততালি শুনলে ফ্যান চালাতে এবং দুবার হাততালি শুনলে ফ্যান বন্ধ করে দিতে। এবার আপনি একবার হাততালি দিলে ঘরে লাগানো সাউন্ড সেন্সর সেটি শুনে অ্যালগরিথমকে জানাবে, অ্যালগরিথম তার সাথে সংযুক্ত সুইচের মাধ্যমে ফ্যান অন করবে, এবং একই ভাবে দুবার হাততালি শুনলে ফ্যান বন্ধ করবে।
এবার বলি কীভাবে এই বিভাগে কেরিয়ার গড়বেন। এই বিভাগের প্রাণ হল ওই অ্যালগরিথম বা সফটওয়্যারটি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। আপনাকে কোডিং শিখতে হবে, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও তার কাজ-ব্যবহার ইত্যাদি আপনাকে জানতে হবে। এছাড়া আপনার কল্পনাশক্তি ভীষণভাবেই দরকার এই কাজে। কারণ আপনাকে বেশ কিছু যন্ত্রাংশ নতুনভাবেও তৈরি করতে হতে পারে। এই বিভাগে সাধারণত জাভা, পাইথন, সি/সি প্লাস প্লাস, জাভাস্ক্রিপ্ট, বা পিএইচপি -এর মত কোডিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করা হয়।
আইওটি এখন পৃথিবীর সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্ত জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি একদমই প্রায় কুটিরশিল্পে পরিণত হবে। সাধারণত দ্বাদশ শ্রেণীর পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার পরেই এই বিষয়ে পড়াশোনা বা কাজ শুরু করা যায়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট কোম্পানি আইওটির উপর প্রশিক্ষণ দেয়।
সংক্ষেপ–
ন্যূনতম যোগ্যতা- দ্বাদশ শ্রেণী পাস,
পড়াশোনা- গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স বা ডিপ্লোমা, চাকরি/ব্যবসার সুযোগ- কিছু নতুন জিনিস বানিয়ে ব্যবসা করতে পারেন, পৃথিবীর সমস্ত প্রতিষ্ঠান এখন আইওটি নিয়ে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে একদম ঘরে ঘরে এই নিয়ে কাজ হবে।
মনে রাখবেন- কল্পনাশক্তি বা উদ্ভাবনীশক্তি, কোডিং, যন্ত্রাংশের জ্ঞান সমস্তটাই দরকার এই বিষয়ে সম্পূর্ণ জানার বা কাজ করার জন্য।
৫। সাইবার এক্সপার্ট বা প্রযুক্তিসুরক্ষা-বিশেষজ্ঞ
কখনও ভেবেছেন? এই যে টিভি/রেডিওতে দেখেন/শোনেন বা সংবাদপত্রে পড়েন যে ব্যাংক থেকে টাকা চুরি গেছে, মোবাইল ফোন চুরি গেছে, কম্পিউটার বা মোবাইল হ্যাক হয়ে গেছে, এগুলি কারা সমাধান করেন বা কীভাবে জানা যায় মোবাইলের লোকেশন? উত্তর হল সাইবার এক্সপার্ট বা প্রযুক্তিসুরক্ষা-বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এনারা বের করেন অপরাধীর লোকেশন বা কোথায় থেকে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সমস্ত ঘটনা পর্যবেক্ষণ, শনাক্তকরণ, তদন্ত, বিশ্লেষণ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা, সিস্টেমগুলিকে সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি, হুমকি এবং দুর্বলতা থেকে রক্ষা করেন। এতে প্রধান কাজ হল নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে সিস্টেমের নিরাপত্তাকে অক্ষুন্ন রাখা।
সাইবার এক্সপার্ট বা প্রযুক্তিসুরক্ষা-বিশেষজ্ঞ হতে গেলে আপনাকে প্রথমেই অবশ্যই কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফর্মেশন টেকনোলজি, বা এই ধরনের কোন ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টে গ্রাজুয়াশন বা স্নাতক স্তর সম্পূর্ণ করতে হবে। তারপর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি সাইবার-টেকনোলজি বা সাইবার-সিকিউরিটির উপর ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা দেয়। আজকাল পুলিশ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুরক্ষাবাহিনীতে সাইবার এক্সপার্ট রাখা হচ্ছে, কিছু জায়গায় এই বিশেষজ্ঞদের বাহিনীও তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া সমস্ত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠানে সাইবার এক্সপার্ট নিয়োগ হয়। এছাড়া আপনি নিজেই নিজের প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারেন, বা কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারেন।
সংক্ষেপ–
ন্যূনতম যোগ্যতা- গ্রাজুয়েশন বা স্নাতক পাস, পড়াশোনা- গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স বা ডিপ্লোমা, চাকরি/ব্যবসার সুযোগ- নিজেই নিজের প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন, রাষ্ট্রের/রাজ্যের সুরক্ষা বাহিনীতে বা তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেন।
মনে রাখবেন- কোডিং, এবং টেস্টিং বা প্রযুক্তির পরীক্ষার জ্ঞান সমস্তটাই দরকার এই বিষয়ে সম্পূর্ণ জানার বা কাজ করার জন্য।
পরিশেষে বলি, যে-কোনও কাজের মুল বিষয় হল আপনি কাজটা করতে পারছেন কিনা। বাকি সবই গৌণ। সুতরাং ডিগ্রি থাকা বা না-থাকার চেয়ে বেশি দরকারি হল কাজটা শেখা, জানা, ভালবেসে কাজটা করা। আপনার কেরিয়ারে মূল বিষয় হল আপনি কাজটা করে সন্তোষবোধ করছেন কিনা। তার সাথে নিজের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোটাও জরুরি। কোনও বিষয়ই ছোট নয়, কোনও কাজই ছোট নয়, তাই আপনার যেটা ভাল লাগে, তার উপর মন দিয়ে লেগে থাকুন, সাফল্য আসবেই। ভাবুন তো, শচীন তেন্ডূলকর যদি একটা সেঞ্চুরি না-পেয়ে দুঃখে ক্রিকেট ছেড়ে গান গাইতে শুরু করতেন অথবা লতা মঙ্গেশকর যদি একটা গান করতে ভালো না-লাগায় দুঃখে গান গাওয়া ছেড়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করতেন, তাহলে আমরা কীভাবেই না বঞ্চিত হতাম!