করোনাভাইরাস সংক্রমণ: প্রতিষেধক ওষুধ ও ভ্যাকসিন(১ম পর্ব):- ড. সমীরণ মণ্ডল
করোনাভাইরাস রোগ 2019 যা কোভিড-১৯ (COVID-19) বলে সবার জানা সেটা হল একটি ভাইরাস জনিত অভিনব শ্বাস প্রশ্বাসের অসুস্থতা, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে উদ্ভুত হয়ে বর্তমানে ২০০ টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ অবহিত হয় যখন ২০১৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে হুবেই প্রদেশের উহান শহরে কিছু মানুষের মধ্যে অজ্ঞাত কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্পর্কে অবহিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে (১ লা ফেব্রুয়ারী, ২০২১) বলা হয়েছে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০ কোটিরও বেশি মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে এবং ২২ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আরও হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে জীবনযাপন করছেন। আমেরিকা, ইতালি, চীন, স্পেন, জার্মানি, ইরান, ফ্রান্স-এ ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। আমেরিকাতে এই সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং সবথেকে বেশি মানুষ মারা গেছেন। ভারতেও এই করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ছাড়িয়েছে এবং দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব ও তীব্রতা পর্যালোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা COVID-19 কে ১১ মার্চ ২০২০ বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রথমদিকে, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান ছিল প্রথম কেন্দ্রস্থল, যেখানে সামুদ্রিক খাবার এবং পশুর বাজারের সাথে কিছু যোগসূত্র ছিল যার ফলে প্রাণী থেকে ব্যক্তিদের মধ্যে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরে বলে মনে করা হচ্ছে। বিগত দুই দশকে করোনাভাইরাস ঘটিত সার্স (SARS ২০০২) এবং মার্স (MERS ২০১২) শ্বাসযন্ত্রের রোগদুটি সৃষ্টি করা ভাইরাসের সাথে জিনগত ও প্রজাতিগত সাদৃশ্য থেকে এই নতুন ভাইরাসকেও একই ভাবে প্রাকৃতিক উৎস বাদুড় থেকেই উদ্ভুত বলে মনে করা হচ্ছে। সার্স এবং মার্স এই করোনাভাইরাস গুলি যথাক্রমে কিছু মধ্যবর্তী স্তন্যপায়ী প্রাণী সিভেট বিড়াল ও উটের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী নতুন করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে মধ্যবর্তী প্রাণী প্যাঙ্গোলিন এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। পরবর্তীতে, যা ব্যক্তি-থেকে-ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পরে (চিত্র ১)।

চিত্র ১: করোনাভাইরাসের উৎস ও মানবদেহে সংক্রমণ
মানবদেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ:-
করোনাভাইরাস সাধারণত সংক্রামিত ব্যক্তির সান্নিধ্য, তাদের কাশি বা হাঁচির সময় শ্বাস ফোঁটাগুলি (ড্রপলেটস) গ্রহণ অথবা এমন কোনও পৃষ্ঠকে স্পর্শ করা যেখানে এই ফোঁটাগুলি অবতরণ করে এবং সেখানে হাত দিয়ে মুখ বা নাক স্পর্শ করা থেকে ছড়িয়ে পড়ে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ (NIH)-এর একদল বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই ভাইরাস এরোসলে অর্থাৎ বাতাসে সূক্ষ্ম ড্রপলেট অবস্থায় প্রায় ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে, কার্ডবোর্ড-এর উপর প্রায় ২৪ ঘন্টা এবং প্লাষ্টিক বা স্টেইনলেস স্টিল এর উপর প্রায় তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এই ভাইরাস সংক্রমণের সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট। গুরুতর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া সংক্রমণ, কিডনি ও লিভার এর কর্মহীনতা, তীব্র শ্বাসযন্ত্রের কষ্ট, একিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম (Acute respiratory distress syndrome, ARDS) বলা হয় যার ফলে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তি যাদের হার্ট বা ফুসফুসের রোগ বা ডায়াবেটিসের মতো রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রবণতা সবথেকে বেশি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রধানত চারটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়ে বিদেশ থেকে আগত রোগীর মাধ্যমে (Imported Cases), দ্বিতীয় পর্যায়ে আঞ্চলিক সংক্রমণ (Local Transmission) অর্থাৎ বিদেশ থেকে আগত রোগীর সান্নিধ্যে এসে, তৃতীয় পর্যায়ে পারস্পরিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ (Community Transmission) যেখানে কীভাবে বা কোথা থেকে সংক্রমণ হয়েছিল তা নিশ্চিত নয় এবং এই পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক দ্রুত, অনেক বড় এলাকা জুড়ে হয়, চতুর্থ পর্যায় মহামারী (Epidemic), সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, একবার শুরু হলে কিভাবে রোধ করা যায় তা বলা অসম্ভব।
বর্তমান সময়ে, ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা সময়ের সাথে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যাকে এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি বলে (চিত্র ২)।

চিত্র ২: মাস ভিত্তিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি
করোনাভাইরাসের আণবিক গঠন ও জৈবিক সংক্রমণ:-
“করোনা” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল মুকুট। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে এই ভাইরাসকে রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায় বলে ভাইরাসের এই নামকরণ হয়েছে (চিত্র ৩)। পূর্বের সার্স-১, মার্স ও নতুন সার্স-২ করোনাভাইরাসের গঠন ও জাতিগত বিন্যাস থেকে দেখা যায় যে সবগুলি ভাইরাস-ই বিটা-করোনাভাইরাস শ্রেণীভুক্ত। করোনাভাইরাসের কাঠামো মূলত চার ধরণের প্রোটিন অনু দিয়ে গঠিত, সেগুলি হলো গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক (S) প্রোটিন, মেমব্রেন (M) প্রোটিন, এনভেলপ (E) প্রোটিন ও নিউক্লিওক্যাপসিড (N) প্রোটিন। এই ভাইরাসে জিনগত উপকরণ হিসেবে একতন্ত্রী পজিটিভ-সেন্স আরএনএ (Positive-sense single-stranded RNA, +ssRNA) উপস্থিত। সার্স-২ ভাইরাস তার বহির্দেশে অবস্থিত কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিনের চাবি দিয়ে মানবদেহের কোষের গ্রাহক প্রোটিন অ্যাঞ্জিওটেনসিন রূপান্তরকারী এনজাইম ২ (ACE2)-র তালা খুলে মানবদেহ কোষের মধ্যে ঢুকে পরে ও করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত করে। পরবর্তীতে, আরএনএ ভাইরাস কোষ মুক্ত হয়ে অনবরত প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে, মানবদেহের কোষের মধ্যে বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরায় ভিরিয়ন (ভাইরাসটির সক্রিয়, সংক্রামক রূপ) তৈরি করে এবং কোষের বাইরে এসে পাশের কোষগুলিকে সংক্রমিত করে (চিত্র ৩)।

চিত্র ৩: করোনাভাইরাসের গঠন ও জৈবিক সংক্রমণ (সরলীকৃত)
কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয় এবং বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি:-
সায়েন্স জার্নাল এ প্রকাশিত গবেষণা তথ্য অনুযায়ী সার্স-২ করোনাভাইরাসটিতে অবস্থিত স্পাইক প্রোটিনগুলির গঠনে পূর্বের ভাইরাসের সাথে বেশ মিল (জিনগত উপাদানের সাদৃশ্য ৮০%-৯০%) কিন্তু সার্স-১ করোনাভাইরাসের থেকে মানব কোষগুলিকে আরও দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে, ফলে নোভেল করোনাভাইরাসটি খুব সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ দ্বারা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পরে। এই মুহুর্তে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া (RT-PCR) ব্যবহৃত হচ্ছে। গলনালীর শ্লেষ্মার নমুনা সংগ্রহ করে তার মধ্যে ভাইরাস আরএনএ উপস্থিত কিনা তা পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া পরীক্ষা করে বলে দেওয়া সম্ভব। PCR এর মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও যাদের ক্ষেত্রে উপসর্গ মারাত্মক বিশেষত ARDS রোগীর ক্ষেত্রে CT স্ক্যান উপসর্গের তীব্রতা নির্ধারণকারী একটি পরীক্ষা পদ্ধতি। বর্তমানে, সার্স-২ করোনাভাইরাসটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করার জন্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) অনুমোদিত কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। তবে সম্প্রতি FDA জরুরিভিত্তিতে (Emergency use authorization, EUA) হাসপাতালে ভর্তি বয়স্ক এবং ২ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের যাদের পরিপূরক অক্সিজেন অথবা যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রয়োজন তাদের চিকিৎসার জন্য ব্যারিসিটিনিবের (Baricitinib) এর সাথে একত্রে রেমডেসিভির (Remdesivir) ব্যবহারে অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে অক্সিজেন থেরাপি ও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট মূলত ব্যবহৃত হচ্ছে। ARDS রোগীদের ভেন্টিলেশন ও নাকের মাধ্যমে উচ্চ প্রবাহ অক্সিজেন প্রেরণের সাহায্যে স্থিতিশীল রাখা হচ্ছে। সার্স-২ করোনাভাইরাস সংক্রমণ নির্ধারণে সেরোলজি টেস্ট বা এন্টিবডি টেস্ট বর্তমানে বহু আলোচিত একটি বিষয়। কারণ এই টেস্টের মাধ্যমে শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষা করে খুবই দ্রুততার সাথে বলে দেওয়া যায় যে কোনো ব্যক্তি সম্প্রতি এই ভাইরাস এর সংস্পর্শে এসেছে কিনা বা তার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে কিনা। রক্তের নমুনার মধ্যে মূলত IgG ও IgM এন্টিবডির উপস্থিতি করোনাভাইরাস সংক্রমণকে নির্দেশ করে।