করোনাভাইরাস সংক্রমণ: প্রতিষেধক ওষুধ ও ভ্যাকসিন(৪র্থ পর্ব): ড. সমীরণ মণ্ডল
আগের পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
•হার্ড ইমিউনিটি এবং ইমিউনিটি পাসপোর্ট:-
হার্ড ইমিউনিটি সংক্রামক রোগ থেকে পরোক্ষ সুরক্ষার একটি প্রকার। টিকা বা ভ্যাকসিন দেওয়ার মাধ্যমে বা পূর্ববর্তী সংক্রমণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইমিউনিটির ফলে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যখন সংক্রমণে প্রতিরোধক হয়ে ওঠে তখন ইমিউন নন এমন ব্যক্তিদের জন্য এটি একটি রক্ষাব্যবস্থা। ইমিউন জনসংখ্যা যত বাড়বে তত ভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা কমতে থাকবে, কারণ সংক্রমণের শৃঙ্খলগঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে আর তার সাথে সাথে রোগের বিস্তার কমতে থাকবে ।

হার্ড ইমিউনিটি
কোভিড-১৯-এর প্রতিরোধী কে এবং কে নন সেটা পরীক্ষা করে সাধারণ জনজীবনে ফিরে আসার পক্ষে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবান মানুষকে ছাড়পত্র দিলে হয়তো সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর পক্ষে তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হবে সেটাই এই ধারণার মূল ভিত্তি। এমতাবস্তায়, বেশিরভাগ দেশ লকডাউন বা কঠোর সামাজিক দূরত্বের প্রতিকারের জন্য এমন এক উপায় সন্ধান করেছে যাতে কোনও টিকা (ভ্যাকসিন)-এর জন্য ১২ থেকে ১৮ মাস অপেক্ষা করতে হবে না। এই ইমিউনিটি টেস্ট সেক্ষেত্রে একটা সমাধানের উপায় হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে দেহে ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম (আই জি এম) এন্টিবডি তৈরি হয় যা স্বল্পকালীন, পরবর্তীতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা এন্টিবডিগুলিকে সংশোধন করে ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি (IgG) এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন এ (IgA) উৎপাদন শুরু করে। এই নির্দিষ্ট IgG রক্তে থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করে। কারণ, কোভিড-১৯ মুক্ত কারও রক্তে অবশ্যই এই এন্টিবডিগুলি বর্তমান থাকে যা পরবর্তীকালে সার্স-২ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবে। ইমিউনিটি টেস্টে যাদের ক্ষেত্রে সেরোলজিকাল পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে তাদের সাধারণ জনজীবনে ফেরার ছাড়পত্র দেওয়া যেতে পারে। যাকে ইমিউনিটি পাসপোর্ট বলা হচ্ছে। যদিও এই অনাক্রম্যতা স্থিতি নির্ধারণের টেস্ট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিরূপ মতবাদও রয়েছে। এন্টিবডিগুলি এই রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে দেখায়, এটি কতক্ষণ স্থায়ী হয়, পুনরায় সংক্রমণকে প্রতিরোধ করে কিনা এবং ভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্তির পরেও কোনো ব্যক্তি সংক্রামক হতে পারেন কিনা সে সম্বন্ধে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এই এন্টিবডি টেস্টের আরও একটি খামতি হলো সংবেদনশীলতা এবং নির্দিষ্টকরণের হার। এখানে যে এন্টিবডিগুলি অন্য সংক্রমণ থেকে বাঁচায় ভুলবশত সেই এন্টিবডিকেও ইতিবাচক ফলাফল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। ফলে এতে ভুলক্রমে মনে হতে পারে যে কোনো রোগী করোনাভাইরাস প্রতিরোধক। পূর্বের ২০০৩ সালে সার্স প্রাদুর্ভাব থেকে বেঁচে যাওয়া রোগীদের শরীরে এই এন্টিবডি প্রায় তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং ২০১২ সালের মার্স রোগীদের শরীরে তা প্রায় এক বছর স্থায়ী ছিল। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে এটা ধারণা করা হচ্ছে যে কোভিড-১৯ থেকে মুক্ত হওয়া রোগীর ক্ষেত্রেও এন্টিবডিগুলি দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। তবে সমস্ত কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে প্রতিরোধ প্রক্রিয়া একইরকম নয়, অল্প বয়স্ক রোগীর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া অধিক শক্তিশালী এবং সেটা কি কারণে সে সম্বন্ধে গবেষণা চলছে। জিনবিন্যাস এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সাবধানতা অবলম্বন
এই ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল এই ভাইরাসের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। এই ভাইরাসের দ্বারা অসুস্থ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। হাত প্রায়শই পরিষ্কার করতে হবে। কমপক্ষে 20 সেকেন্ডের জন্য হাত প্রায়শই সাবান এবং জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে, বিশেষত কোনও সর্বজনিক স্থানে থাকার পরে বা কাশি বা হাঁচি দেওয়ার পরে। যদি সাবান এবং জল সহজেই না পাওয়া যায় তবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যাতে কমপক্ষে ৬০% অ্যালকোহল থাকে। হাত না ধুয়ে চোখ, নাক এবং মুখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলা। ভাইরাস শরীরে ঢুকলেই আপনি যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন এমন কোনো কথা নেই। বিরাট সংখক মানুষ যাদের ভাইরাস টেস্ট এ পসিটিভ বলে শনাক্ত করা হয়েছে কিন্তু কোনো মারাত্মক অসুস্থতা হয়নি। তথাপি, যদি আপনার অঞ্চলে COVID-19 ছড়িয়ে পড়ে তবে নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপগুলি নিতে হবে সেগুলি হল-অসুস্থ বোধ করলে বাড়িতেই থাকুন, কাশি বা হাঁচির সময় কনুইয়ের অভ্যন্তরটি ব্যবহার করে বা মুখ এবং নাকটি টিস্যু দিয়ে আবৃত করে রাখুন, অন্য লোকের আশেপাশে থাকার সময় মাস্ক দিয়ে নাক ও মুখ আচ্ছাদিত রাখুন (চিত্র ৭)। এইসময়ে শুধুমাত্র কতগুলি ইতিবাচক তথ্য নির্ভর হয়ে অনেকেই সহজেই এবং দ্রুত সমাধানের দিকে ঝুঁকে আছে যে কোনো “অলৌকিক ওষুধ” (Miracle drug) হয়তো বাজারে আসছে। কিন্তু, তথাপি আমাদের উচিত তথ্যের সঠিক মূল্যায়ন করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বা FDA অনুমোদিত ওষুধ সেবন করা যাতে ওষুধগুলি তাদের সমাধানের চেয়ে আরও বেশি সমস্যা তৈরি না করে এবং রোগের চেয়ে বড় সমস্যা না হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানী এবং ডাক্তাররা করোনভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বাগ্রে রয়েছেন। তারা এই মারাত্মক রোগের সম্ভাব্য সমাধানের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সাবধানতা
এই পরিস্থিতিতে ভাইরাসের মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব (Physical Distance) বাড়িয়ে দেওয়া এই ধরণের ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভাইরাস একজনের থেকে অনায়াসে অন্যজনের কাছে না পৌঁছতে পারে। প্রত্যেক মানুষকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চ (ICMR) এবং সরকারি-প্রশাসন-এর নির্দেশিকা অনুসারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তবেই এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি রোধ করা সম্ভব। গত শতাব্দীর সবথেকে বড় মহামারী ১৯১৮ সালের ফ্লু যা স্প্যানিশ ফ্লু নামে খ্যাত যার জন্য H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দায়ী, পার করে আমরা আজ যেখানে বর্তমানে শতাব্দীর সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সেখানে ভয় নয় সাবধানতাই হল এই ভাইরাস এর প্রকোপ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। এটা আশা করা যেতেই পারে, কোভিড-১৯ থেকে মুক্ত হওয়া রোগীদের রক্তের মধ্যেই হয়তো রয়েছে আমাদের ভাইরাস থেকে মুক্তি পাবার চাবিকাঠি, তবে সেটা জানার জন্য এখনো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
(সমাপ্ত)
👌👌👌🙏🙏🙏