করোনাভাইরাস সংক্রমণ: প্রতিষেধক ওষুধ ও ভ্যাকসিন(৩য় পর্ব): ড. সমীরণ মণ্ডল
(আগের পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
চিনা গবেষকদের একটি দল প্রথম সার্স-2 করোনাভাইরাসটির জিনগত সজ্জা প্রকাশ করেছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা দলগুলিকে ভ্যাকসিন তৈরিতে আগ্রহী হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি কোম্পানি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই জাতীয় একটি ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রথম থেকেই তোড়জোড় শুরু করে। গতবছরের শেষদিকে দু’শোটিরও বেশি ভ্যাকসিন প্রার্থী ক্লিনিকাল ট্রায়াল এর বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল। এর মধ্যে কমপক্ষে বাহান্নটি ভ্যাকসিন মানব শরীরে পরীক্ষার শেষের পর্যায়ে এবং কতকগুলি ভ্যাকসিন প্রার্থী ট্রায়াল-এর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের এখানে জেনে রাখা দরকার যে সাধারণত একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য তিনটি প্রধান পন্থা রয়েছে। তারা সম্পূর্ণ ভাইরাস বা জীবাণু ব্যবহার করে কিনা; জীবাণুটির কেবলমাত্র সেই অংশগুলি যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালিত করে; বা কেবল জেনেটিক উপাদান যা সম্পূর্ণ ভাইরাস নয় কিন্তু নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির জন্য নির্দেশাবলী সরবরাহ করে।
সমস্ত ভ্যাকসিন মূলত রোগ সংক্রামক জীবাণুর বিরুদ্ধে একই রকমের মৌলিক নীতি অনুসারে কাজ করে। খুবই কম পরিমান ব্যবহারে তারা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উজ্জীবিত করে জীবাণুর বিরুদ্ধে সক্রিয় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে। অ্যান্টিবডিগুলি হ’ল এক প্রকারের রোগ প্রতিরোধের স্মৃতি বহনকারী যৌগ, যা কোনো ব্যক্তিকে সংক্রামক জীবাণুর বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। কোভিড-১৯ মহামারীটি বিশ্বজুড়ে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর পাশাপাশি সামাজিক, শিক্ষামূলক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিনগুলি যাতে সমস্ত দেশের নাগরিকের কাছে সঠিক সময়ে পৌঁছয় সেদিকে সচেষ্ট রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে COVID-19 এর জন্য মডার্না (Moderna) বায়োটেক সংস্থার COVID-19 mRNA-1273 ভ্যাকসিন, এটি জেনেটিক উপাদান নির্ভর ভ্যাকসিন, যা ১৮ বছর বা তার বেশি বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবকদের দেহে ভাইরাস এর আরএনএ (mRNA) প্রয়োগ করা হয়েছে, এই সংকেত মানবদেহে ভাইরাস এর প্রোটিন (Translation) তৈরি করবে, প্রতিরক্ষা কোষ তৈরি করবে এন্টিবডি। দেখা গেছে, এই ভ্যাকসিন ৯৪.১% ক্ষেত্রে কার্যকরী। এখানে উল্লেখযোগ্য, আমাদের দেশের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভিরোলজি (NIV) ভারত বায়োটেক সংস্থার সাথে একযোগে তৈরি কোভ্যাক্সিন (Covaxin)। এটি পোলিও ভ্যাকসিন এর মতোই ইনএক্টিভেটেড ভ্যাকসিন। জরুরীকালীন ভিত্তিতে, ড্রাগস্ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (DCGI)-সেন্ট্রাল ড্রাগস্ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানিজশন (CDSCO) এই কোভ্যাক্সিন কে অনুমোদন প্রদান করেছে এবং ইতিমধ্যে ফেজ-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ ২৬০০০ অংশগ্রহণকারীকে এই ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছে। দুটি ভ্যাকসিন-ই ২৮ দিনের ব্যবধানে ২ টি ডোজ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও আস্ত্রাজেনেকা (AstraZeneca) এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি অ্যাডেনোভাইরাস ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড (Covishield) ভ্যাকসিন। শিম্পাঞ্জির দেহ থেকে প্রাপ্ত একটি দুর্বল অ্যাডেনোভাইরাস সংস্করণ এর উপর নির্ভর করে তৈরি। অ্যাডেনোভাইরাসগুলি সাধারনত মানবদেহে নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে এবং সক্রিয় অ্যান্টিজেন সরবরাহ করে যার ফলে মানবকোষ উদ্দীপিত হয়ে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করতে শুরু করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জনসন এবং জনসন (Johnson & Johnson, Janssen Biotech Inc.) একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে যা ফাইজার (Pfizer) এবং মডার্না (Moderna) বায়োটেক সংস্থার ভ্যাকসিনগুলির চেয়ে আলাদাভাবে কাজ করে এবং COVID-19 প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এখানেও অ্যাডেনোভাইরাস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের সাধারণ কারণ। কিন্তু এখানে জিনগত উপাদান হিসেবে ডিএনএ (DNA) কে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেই ডিএনএ-র রূপকে এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছে যেখানে সার্স করোনাভাইরাস-২ এর কিছু অংশ ব্যবহার করে এমন গঠন তৈরি করা হয়েছে যা মানবদেহে প্রবেশের পর করোনাভাইরাস-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরিতে সক্ষম হয় ও এই ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণের জন্য অতি শীতল পদ্ধতির প্রয়োজন হয় না। প্রথমদিকে, জনসন এবং জনসন ভ্যাকসিনটি প্রথম ডোজ প্রাপ্ত ৯০% অংশগ্রহণকারীর মধ্যে SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে এই ভ্যাকসিনের ১টি ডোজ মাঝারি থেকে মারাত্মক COVID-19 প্রতিরোধে ৬৬% কার্যকর এবং COVID-19 নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু প্রতিরোধে ১০০% কার্যকর। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে জরুরীকালীন ভিত্তিতে FDA এই জনসন এবং জনসন ভ্যাকসিন ব্যবহার কে অনুমোদন প্রদান করেছে।
•করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা এবং তার ভয়াবহতা হ্রাস:
সার্স-২ করোনাভাইরাস একটি RNA ভাইরাস, এটি সাময়িক বাসা বাধে কোষের সাইটোপ্লাজম এ কিন্তু নিউক্লিয়াস এর ডিএনএ এর মধ্যে ঢুকে পরে চিরতরে মানব দেহের কোষে থেকে যাবার শক্তি নেই। করোনাভাইরাস নিজের গঠনের অনবরত স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন (Spontaneous Mutation) করে চলেছে । কিন্তু সমস্ত ভাইরাস আর তার ধারক মানবদেহের কোষের (Host Cell) এক আশ্চর্য বোঝাপড়া সংক্রান্ত যত গবেষণা হয়েছে তার ফল ঠিক উল্টো কথা বলছে। ভাইরাস যখন প্রচুর লোককে সংক্রামিত করে অর্থাৎ মহামারী (Pandemic), রূপে দেখা দেয়, তখন ভাইরাসের নিজের মধ্যেও প্রবল চাপ (Selection Pressure) সৃষ্টি হয় ধারক (Host) কে নিঃশেষ না করে ফেলার , কারণ ভাইরাস ধারক ছাড়া একা একা বাঁচতে পারে না। নিজের বেঁচে থাকার স্বার্থেই ধারককে বাঁচিয়ে রাখা ভাইরাস এর ভীষণ প্রয়োজন তাই যেকোনো বড় আকারের সংক্রমণের পরেই ভাইরাসের পরিব্যক্তি (Mutation) এমন ভাবে হয় যাতে তার ভয়াবহতা (Virulence) নিজের থেকেই কমে যায়। তখন ভাইরাস এর একটাই লক্ষ্য থাকে মানুষের দেহ ছেড়ে আবার চোখের অগোচরে কোনো আধার (Reservoir) এ ঢুকে পরে নিজেকে ছোটো ভাবে বাঁচিয়ে রাখা।
ফ্ল্যাটেনিং কার্ভ (Flattening the curve)
বর্তমান সময়ে, ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা সময়ের সাথে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, যাকে এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি (exponential growth) বলে। এই বৃদ্ধির হারটা কমিয়ে দেওয়া অর্থাৎ এই কার্ভটাকে একটু চ্যাপ্টা করা (‘flattening the curve’) সব দেশের উদ্দেশ্য (চিত্র ৫)। ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের বহু দেশ COVID-19 এর সংক্রমণ আটকানোর জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপন ও চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিল, যাকে সম্পূর্ণ লকডাউন (Lockdown) বলে আমরা সবাই জানি এখন। হয়তো, এর সুফল আমরা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাবো।

চিত্র ৫: Flattening the Curve
(ক্রমশ)