করোনাভাইরাস সংক্রমণ: প্রতিষেধক ওষুধ ও ভ্যাকসিন(২য় পর্ব): ড. সমীরণ মণ্ডল
প্রথম পর্বটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
কোভিড-১৯ এবং ইমিউনিটি:-
মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা বা ইমিউন সিস্টেমের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো স্বকীয়তা বজায় রেখে দেহের বাইরে থেকে আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করা এবং তাদেরকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নির্মূল করা। T কোষ (T Cells), এক ধরণের শ্বেত রক্তকণিকা যা এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। T কোষের রিসেপ্টর বা সংকেত গ্রহণ কেন্দ্রগুলি (Receptors) কোষের বাহ্যিক জৈবিক অণু বা পদার্থের সাথে আবদ্ধ হয় এবং মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৮০% রোগীর ক্ষেত্রেই সংক্রমণের মাত্রা কম বা উপসর্গহীন। কিন্তু ১৫% ক্ষেত্রে তীব্র এবং ৫% রোগীদের বিশেষ করে ARDS রোগীদের ক্ষেত্রে সংকটপূর্ণ যেখানে অক্সিজেন থেরাপি বা ভেন্টিলেশন আবশ্যিক। উল্লেখযোগ্যভাবে, সার্স-২ করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেহের সহজাত (Innate) এবং অভিযোজিত (Adaptive) প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয় করে তোলে ও একটি দ্রুত এবং সুসংহত ইমিউন প্রতিক্রিয়া ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু অত্যধিক সক্রিয়তা দেহের সুস্থ কোষের জন্য ক্ষতিকারক এবং সার্স-২ করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে একিউট লাঙ ইনজুরি (ALI) ও একিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম (ARDS) এর জন্য দায়ী। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের লিমফোপেনিয়া একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যেখানে CD4+ ও CD8+ T-কোষ, B-কোষ ও NK-কোষের সংখ্যা খুব কম হয়। মনোসাইট, ইওসিনোফিলস এবং বেসোফিলের উপস্থিতও হ্রাস পায়। যে সমস্ত রোগীরা কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে বা স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে তাদের মধ্যে CD4+ ও CD8+ T-কোষ, B-কোষ, NK-কোষ এবং সাইটোটক্সিক লিম্ফোসাইটের পরিমান স্বাভাবিক থাকে। তদুপরি, SARS-২ করোনাভাইরাস-নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডিগুলি সনাক্ত করা যায়। গুরুতরভাবে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষত ARDS রোগীদের অত্যধিক সাইটোকাইন ক্ষরণ অর্থাৎ IL-6, IL-2, IFN ইত্যাদির এর মাত্রা অনেকটাই বর্ধিত হয়। যার ফলে সাইটোকাইন স্ট্রম (Cytokine strom) এর সৃষ্টি হয় যা অসুস্থতার মাত্রাকে আরো অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রতিষেধক ড্রাগ এবং ভ্যাকসিন:-
যদিও বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিক মানুষ এই করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কাছে এই মারাত্মক রোগের জন্য কোন নির্দিষ্ট প্রতিষেধক ড্রাগ এখনো নেই। অতি সাম্প্রতিক ক্লিনিকাল পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে যে সমস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে পরিপূরক অক্সিজেন অথবা যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন প্রয়োজন তাদের জন্য জরুরিভিত্তিতে FDA রেমডেসিভিরকে অ্যান্টিভাইরাল প্রতিষেধক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। মরণাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে যাদের পরিপূরক অক্সিজেন অনেক বেশি প্রয়োজন তাদের জন্য ডেক্সামেথাসন (Dexamethasone), যা একটি কর্টিকোস্টেরয়েড, সুপারিশ করা হয়েছে। সার্স-২ ভাইরাসটি সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিলিপি গঠনের মাধ্যমে অতিদ্রুত সংক্রামিত হয় এবং পরবর্তীতে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাকে অতি সক্রিয় করে তোলে। অ্যান্টিভাইরাল প্রতিষেধক সেক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রভাব ফেলতে পারে। সেই কারণে, গবেষকরা বিভিন্ন ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক অ্যান্টিভাইরাল প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্রতী আছেন।
এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সম্মুখ সমরে অনন্ত গবেষণার মাধ্যমে তুলে আনছেন একের পর এক যুগান্তকারী তথ্য। বিশ্বের সমস্ত দেশ এই নতুন করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং মৃত্যুহার হ্রাসে এখন এই ওষুধ আবিষ্কার অথবা টিকা তৈরীর লক্ষ্যে তাদের প্রয়োজনীয় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO), ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি (EMA), ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA), ও ওষুধ প্রস্তুতকারীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান-এর সাথে সমন্বয় সাধন করে ভ্যাকসিন প্রস্তুতি, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ উৎপাদন এবং মনোক্লোনাল এন্টিবডি থেরাপির উপর গতি আনার চেষ্টা করে চলেছেন।
আণবিক গঠন ভিত্তিক জীববিদ্যা নির্ভর (Structural Biology)-করে সহজ ভাষায় বলতে গেলে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের চাবি দিয়ে মানবদেহের কোষের গ্রাহক প্রোটিন অ্যাঞ্জিওটেনসিন রূপান্তরকারী এনজাইম ২ (ACE2)-র তালা খুলে মানবদেহ কোষের মধ্যে ঢুকে পরে ও করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত করে (চিত্র ৩)। ভাইরাসের স্পাইক আর মানবদেহকোষের ACE2 প্রোটিনের সংযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ আণবিক গঠনের সাথে যে রাসায়নিক যৌগের গঠন সঠিকভাবে মিলে যাবে একমাত্র সেই সমস্ত যৌগগুলি সুনিপুন ভাবে আটকে দেবে করোনাভাইরাসের মানবদেহে ঢুকে যাওয়াকে। সুপার কম্পিউটার ভিত্তিক কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) প্রয়োগ করে অতি সহজেই এবং দ্রুত বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে ভাইরাসটি কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, কীভাবে এটি পরিচালনা করতে পারে এবং কীভাবে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব থাকতে পারে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে গবেষকেরা অনেকগুলি রাসায়নিক তৈরি করেছেন যা দিয়ে বন্ধ করা যেতে পারে এই ভাইরাস এর দেহকোষে ঢুকে পরা।
এর মধ্যেই অনেকগুলি যৌগ বর্তমানে ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটি প্রতিষেধক ওষুধ বা ভ্যাকসিন বাজারে আসার আগে বিভিন্ন ধাপে সঠিকভাবে পেরিয়ে অনুমোদন প্রাপ্ত করে (চিত্র ৪)।

চিত্র ৪: ক্লিনিকাল ট্রায়াল এর বিভিন্ন পদক্ষেপ
গবেষকরা সাধারণত যখন কোনো প্রতিষেধক ওষুধ বা ভ্যাকসিন বিকাশের দিকে এগোতে থাকেন, তখন তারা একাধিক সংস্করণ তৈরি করেন এবং কোন সংস্করণ ক্ষয়ক্ষতির (নিরাপত্তা) কারণ ছাড়াই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী (কার্যকারিতা) সেটা নির্ধারণ করেন। সম্প্রতি, প্রতিষেধক ওষুধ সন্ধানের একটি নতুন দিক উঠে এসেছে যার নাম পুরোনো ওষুধের নতুন ভাবে পুনর্ব্যবহার যাকে Drug Repurposing বলা হচ্ছে যেখানে অন্য রোগের চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত ওষুধকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ, এই ভাইরাসের জেনোমিক বিন্যাস ও প্রতিরূপ তৈরি করার প্রকৃতি পূর্বের মার্স, সার্স রোগের মতোই। গিলিড সায়েন্সেসের পরীক্ষামূলক ওষুধ রেমেডিসিবির (Remedesivir) পূর্বে মার্স এবং সার্স এর ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে কাজ করেছে যার বর্তমানে সার্স-2 এর বিরুদ্ধে ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি, সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে EIDD-2801 নামে পরিচিত একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ যা রেমেডিসিবির এর থেকেও অধিক কার্যকরী। এটি করোনভাইরাস আরএনএ (RNA) তে মিউটেশন ঘটিয়ে ভাইরাল আরএনএ কে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে যে এটি আর অন্য কোষগুলিকে সংক্রামিত করতে পারে না। এখন এটি মানবদেহে ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে, তবে এর প্রভাব যদি মানবদেহের মধ্যে একইরকম হয় তবে ওষুধটি COVID-19 মহামারীতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, সাময়িক সময়ে সবথেকে বিতর্কিত ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন উভয়ই এফডিএ (FDA)-অনুমোদিত অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল ওষুধ যা বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্লোরোকুইন মূলত 1934 সালে ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা বায়ার তৈরি করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়েছিল। হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় স্থান পেয়েছে যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর ওষুধ। সরকারীভাবে হাইড্রোক্সেক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়া, রিউম্যাটয়েড আর্থরাইটিস এবং লুপাসের চিকিত্সার জন্য অনুমোদিত। একটি সস্তা ও সহজেই পাওয়া ওষুধ। হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন মানবদেহে লোহিত রক্ত কণিকায় উপস্থিত ম্যালেরিয়া পরজীবীকে বিনষ্ট করতে সহায়তা করে এবং অ্যাজিথ্রোমাইসিন একটি অ্যান্টিবায়োটিক যা বেশ কয়েকটি ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়; এটি তাদের প্রোটিন সংশ্লেষণে বাধা দিয়ে ব্যাকটিরিয়া বৃদ্ধি রোধ করে। হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন এবং অ্যাজিথ্রোমাইসিন ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কিভাবে কাজ করে তা এখনও অস্পষ্ট। এটা ধারণা করা হচ্ছে যে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন এন্ডোসোম (Endosome)-এর পি এইচ (pH) পরিবর্তন করতে সাহায্য করে এবং ভাইরাসটির প্রবেশ ও পরিবহন প্রতিরোধ করে। কারণ, এন্ডোসাম ভাইরাসটির আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরিতে সাহায্যকারী এবং ভাইরাস সমাবেশের জন্য দায়ী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে এই হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ওষুধটির অনেকগুলি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যেগুলির মধ্যে বমিভাব, মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি এবং পেশী দুর্বলতা অন্তর্ভুক্ত। যে সমস্ত রোগীর পূর্বে হার্টের সমস্যা বিদ্যমান তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া সেবন করলে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এই ওষুধকে ব্যবহার করার আগে বিশেষজ্ঞদের মতামত হল ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার। জাপানের প্রধানমন্ত্রী গতবছর সাংবাদিক সম্মেলনে ফভিপিরাভিড় (Favipiravir) যা অভিগান (Avigan) নামেও পরিচিত তার উপর জোর সওয়াল করেন এবং COVID-19 এর বিরুদ্ধে চিকিৎসা হিসাবে মনোনীত করে ওষুধের উৎপাদন বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেন। ওষুধটি জাপানের ফুজিফিল্ম তোয়ামা কেমিক্যাল সংস্থা তৈরি করেছে। এর আগে এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা সহ বেশ কয়েকটি আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। জাপান ২০১৪ সালে এর অনুমোদন প্রদান করে। রাশিয়াও এই ফভিপিরাভিড় এর ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে, কারণ চীনে COVID-19 এর বিরুদ্ধে “দুর্দান্ত ফলাফল” প্রদর্শন করেছে। চীন সরকার ইতিমধ্যে এই ওষুধটিকে COVID-19 এর বিরুদ্ধে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু FDA এখনও এই ওষুধ ব্যবহারে ছাড়পত্র দেয়নি।
যে সমস্ত বয়স্ক রোগীরা COVID-19 এ ফুসফুসের সংক্রমণে মুমূর্ষু হচ্ছেন তাদেরকে রক্ষা করতে জটিল রিউম্যাটয়েড আর্থরাইটিস এর জন্য ব্যবহৃত ওষুধ একটেমরা (Actemra) খুব ভালো কাজ করছে। এটি এখন ক্লিনিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ পর্যায়ে (Phase III)।
(ক্রমশ)
সব medical term সম্পর্কে বোঝার অসুবিধা হলেও এই আলোচনা covid-19 ব্যাপারে সচেতন করছে।এর জন্ম
ধন্যবাদ।