Recent Post

এপ্রিল ফুল: শান্তনু ভূঁইয়া

এপ্রিল ফুল: শান্তনু ভূঁইয়া

“পিয়া কি নাজারিয়া জাদুভরি….”, সকাল সকাল স্নান সেরে আজ অনেকদিন পরে তানপুরাটা নিয়ে একটু গলা সাধছিল মানসী। কাল রাত থেকেই মনটা খুশি হয়ে আছে। পাঁচ মাস পরে আজ আসছে ছেলেটা। আজ পয়লা এপ্রিল, তার নয়নের মণি বাবানের অর্থাৎ সায়নদীপ বসুর জন্মদিন। এই দিনটা কখনো মিস করো না ছেলেটা। কলেজ হোস্টেল অথবা চাকরি যেখানেই থাকুক জন্মদিনে সে তার মা-বাবার কাছে ঠিক আসবেই। এই গানটা ছোটোবেলায় খুব ভালোবাসতো সায়ন। গানটা গাইতে গাইতে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছিল মানসীর।

“ওগো শুনছো, একটা ভালো খবর আছে, বর্মনদা মাদার হাউসে যোগাযোগ করে আমাদের সেখানে যেতে বলেছে।” অফিস থেকে ফিরে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে পার্থ। 

মানসীও এক বুক আশা নিয়ে ছুটে আসে। প্রায় ছয় বছর বিয়ে হয়েছে কিন্তু সন্তানসুখ পায়নি। অবশেষে মাদার হাউজ থেকে পার্থ আর মানসী নিজেদের সবটুকু ভালোবাসা তোয়ালেতে মুড়ে নিয়ে এসেছিল ছোট্ট সায়নকে। বোধহয় মাস ছয়েক হবে। ট্যাক্সিতে সারাক্ষণ মানসীর একটা আঙুল ধরে ছিল, যেন কত দিনের অপেক্ষা। সেদিন ছিল পয়লা এপ্রিল। সেই থেকে ওই দিনেই সায়নের জন্মদিন। মানসী সন্তানের অভাবে খানিকটা মানসিক রোগী হয়ে গেছিল। আদরের বাবানকে পেয়ে তার বাঁধভাঙ্গা মাতৃত্বের সুখ। সারাটা দিন বাবানকে নিয়ে কাটে তার। পার্থ খুব খুশি সাত রাজার ধন এক মানিক বাবানকে পেয়ে আর আরো খুশি তার পুরোনো মানসীকে খুঁজে পেয়ে। একটি একটি দিন বছর পেরিয়ে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠল বাবান। ছেলেকে একমুহূর্তও কাছ ছাড়া করতে চাইতো না মানসীর মন। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হোস্টেলে থাকতে হবে শুনে মানসী প্রচন্ড অশান্তি করেছিল। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করেছিল পার্থ। ছেলেটাও চরম নেওটা মায়ের। কলেজে দিন হোক বা চাকরি করে ফেরৎ, মায়ের সাথে সাথে ঘুরবে আর হাজার কথা। পার্থর মাঝে মাঝে হিংসা হলেও নিজেকে বোঝায় এই তো বেশ ভালো।

দরজার বেল বাজতে হুশ ফিরল মানসীর। দরজা খুলে দেখে পার্থ দুই ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে হাজির। “একী গো? এত বাজার! ছেলে আসবে বলে এতকিছু? তোমার কি মাথা খারাপ হল?” হালকা চালে কথাগুলো বলে মানসী। 

 এপ্রিল-ফুল-Nabataru-e-patrika
এপ্রিল-ফুল-Nabataru-e-patrika

“হা…হা…গিন্নি, শুধু ছেলে? লেফটেন্যান্ট সায়ানদীপ বসু বলে কথা। হুঁ-হুঁ বাবা চাট্টিখানি কথা?” পার্থ উত্তর দেয়। 

“ওসব আমি বুঝিনা বাপু, ও আমার সেই ছোট্ট বাবান।” হাসিমুখে ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে যায় মানসী।

দুপুরে খেতে খেতে পার্থ বলে, “নূপুর মেয়েটিকে কিন্তু আমার ভারি পছন্দ হয়েছে, বাবানেরও বোধহয় পছন্দ। গতবার তো আড়ি পেতে শুনছিলাম দুজনে ভালোই গল্প করছিল। বোধহয় দেখা সাক্ষাৎও করেছে। এবার কি পাকা কথাটা সেরেই নেব? উফফ কত্তদিন বাড়িতে বড় করে অনুষ্ঠান খাওয়া-দাওয়া হয়নি।” 

“তুমি আমার মনের কথাটাই বলেছ, মেয়েটাকে আমারও বেশ ভালো লেগে গেছে, কেমন যেন মায়ালু আর সহজেই আপন হয়ে যায়। আসুক বাবান এবার। তোমায় আরেকটা মাছ দিই? একগাদা বাজার করেছ, খাও এবার।” 

“ইয়ে দোস্তি হাম নেহি ছোরেঙ্গে.. কই গো আজ খেতে দিবিনে?” জানলা দিয়ে পাগলটার মুখ দেখে একটু ব্যাঘাত ঘটলো সুখের আলোচনায়। “যাও তোমার ছেলের স্যাঙাত এসেছে, ভুরিভোজ করাও”—বলে পার্থ উঠে যায়। 

পাড়ার এই আধ-পাগল লোকটির সঙ্গে ভারি ভাব সায়নের। দুটিতে মাঝে মাঝে খোশগল্প জোড়ে, পাগলটার সঙ্গে কথা বলে কী আরাম যে পায় কে জানে! সায়ন বলে গেছিল, “মা, ওই কাকুটার কেউ নেই খুব দুঃখ, তুমি দুপুরবেলা ওকে একটু খেতে দিও।” 

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বেশ খোশমেজাজে দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলল। মানসী গেল খাবার নিয়ে কর্তব্য সারতে আর পার্থ খবরের কাগজটা নিয়ে বিছানায়।

“আরে সন্ধে হয়ে এল, বাবানের ট্রেন তো এতক্ষণে চলে আসার কথা! তুমি একটু এগিয়ে দেখবে? ফোনটাও সুইচ অফ, মনে হয় চার্জ শেষ।”  মানসীর চঞ্চলতা বাড়ছে। ” আরে তোমার ছেলে গুড বয়, স্টেশন থেকে সোজা তোমার কাছেই আসবে।” আশ্বস্ত করে পার্থ। কিছুক্ষণ পরেই ডোর বেল বাজার শব্দ। প্রায় দৌড়েই যায় পার্থ, মনে মনে সে ও ব্যাকুল।

“কী গো? আরে ভেতরে এসে কথা বল না। ওইখানে দাঁড়িয়েই শুরু হয়ে গেছে। ছেলেটা এতক্ষণ জার্নি করে এল।” চেঁচিয়েই বলল মানসী। 

মিনিট পাঁচেক পরে নিজেই এগিয়ে গেল দরজার দিকে। একি! বাইরে অনেকগুলো লোক, পার্থ কথা বলছে কয়েকজনের সাথে। “কালকে হঠাৎই লাদাখ বর্ডারের দিকে চিনের সেনারা আক্রমণ করে। দু’দিন আগেই খবর ছিল, স্যার ছুটি ক্যানসেল করে আমাদের লিড করছিলেন। আজ ভোরের দিকেই হঠাৎই একটা হ্যান্ড গ্রেনেড বার্স্ট করে..” আরও কীসব যেন বলছিল লোকগুলো। 

মানসীর চোখ নিথর বাবানের দেহখানা খুঁজে নেয়। “বা বা ন…..   বা বা ন এভাবে না বাবা, একবার উঠে দাঁড়া সোনা। আমাদের তুই এভাবে আজকের দিনে ছেড়ে যেতে পারিস না বাবান।” 

পার্থ তাড়াতাড়ি কাছে আসে মানসীর, মা হিসেবে এই আঘাত যে কী মর্মান্তিক তা বুঝতে কষ্ট হয় না পার্থর। পার্থকে কাছে পেয়ে অবলম্বনের মতো জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদতে থাকে মানসী, “ওগো এ কী হল! ছেলেটা দু’দিনের জন্য কি তবে এসেছিল? আজ জন্মদিনে আমাদের এপ্রিলফুল করে চলে গেল? এপ্রিল ফুল! ফুল! ফু. ল..” —বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গেল মানসী।

“একবার বিদায় দে মা হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ….” পাড়ার পাগলটা একটা আধ ছেঁড়া গাঁদা ফুলের মালা নিজের গলায় পরে গাইতে গাইতে চলে গেল।

Author

  • শান্তনু ভূঁইয়া

    অধুনা পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল শহরে ১৯৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন কবি শান্তনু ভূঁইয়া। স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশন হতে মাধ্যমিক ও হুগলি মহসিন কলেজ হতে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক স্তরের পাঠ সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি ভারতীয় রেলের অধীনে চন্দননগর স্টেশনে 'স্টেশন মাস্টার' পদে কর্মরত। অবসর সময়ে বই পড়া, খেলাধুলা ও বন্ধুদের সঙ্গে অরাজনৈতিক আলোচনা করতে পছন্দ করেন তিনি। হুগলি জেলার চুঁচুড়ার কবি শান্তনু ভূঁইয়ার বিভিন্ন লেখালেখি সাম্প্রতিক কিছু ই-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

শৈশবের গরমকাল: মধুরিমা বন্দ্যোপাধ্যায়

    শীত বুড়ির চাদর পেড়িয়ে যখন গ্রীষ্মকাল আসে দাবদাহ যেন ভৈরব সন্ন‍্যাসীর মতন তাড়া করে। আমাদের ছোটবেলায় মুঠোফোন অনেক দূরের ব‍্যাপার লোডশেডিং এর পাড়ায় কার্টুন দেখাও ছিল শক্ত কাজ।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: সুব্রত চৌধুরী
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

     শৈশবের গরমকাল: সুব্রত চৌধুরী

      সেদিনও ছিল উষ্ণতার রুদ্র পরাক্রম-মন্দ্রিত দুপুরের নৈঃশব্দ্য। ছিল চৈত্র শেষে চড়ক, শিবের গাজন আর তুলসীতলায় বসুন্ধরার আয়োজন

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      শৈশবের গরমকাল: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      শৈশবের গরমকাল:

        স্মৃতির মনিকোঠায় শৈশব আমার জীবনে এখন ঝরাপাতা।

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন