Recent Post

উৎপীড়িত পতি পরিষদ: সুব্রত মজুমদার

 কানের কাছে একটা ‘পোঁ-ও-ও’ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল প্রকাশের। না, এমনটা তো হওয়ার নয়, দিব্যি মনে আছে, রীতিমত মশারি টাঙিয়ে শুয়েছিল । তাহলে কি কোনওভাবে কোনও ছিদ্রপথে ঢুকে পড়ল এ শয়তান? সেটাও হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেটা হলে গামা পালোয়ানের চেহারার পিণ্ডিদাতার জননীটি সবার আগে উঠে বসত। আর উঠেই প্রশান্তর পিতৃ ও মাতৃপক্ষের তিনপুরুষ উদ্ধার করে অর্ধাঙ্গের দিকে নজর দিত। কিন্তু তা যখন হয়নি তখন গড়বড় একটা ঘটেছে।

 ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল প্রকাশ। নাইট বাল্বের ঘোলাটে আলোয় যা দেখল তা মোটেই সুখকর নয়। সে কেত মেরে পড়ে আছে মেঝেতে, আর পাশেই বাপের দেওয়া খাটে মশারির ভেতর শুয়ে ঘড়ঘড় করে নাক ডাকছে মিতা। মানে ঘুমের ঘোরে মেসি নেইমারের স্টাইলে একটা গোল দেওয়া হয়েছে। বলটি গোলপোস্ট পেরিয়ে চলে গেছে মাঠের বাইরে। 

কোমরে হাত দিয়ে যন্ত্রনায় মুখটা বিকৃত করে ওঠে। ঘুমের ঘোর কাটতেই ব্যাথাটা মালুম হচ্ছে। এ প্লেয়ারের সাথে তো আর কমদিন খেলছেন না প্রশান্ত, পনেরো বছর। আর এই পনেরো বছরে পুরুষসিংহ পরিণত হয়েছে খাঁচায় পোষা ম্যাওপুষিতে। নসিব আপনা আপনা। সেই যে বাতিল মাল রংচং করে গছিয়ে দিল…..। 

ঘোলাটে আলোয় ঠিকমতো দৃষ্টি আর চলে না, কোনোরকমে উঠে গিয়ে আলোটা জ্বালল। হ্যাঁ, কিস্তি মাত করে দিয়ে যুবরাজ আর রানি নিদ্রা যাচ্ছেন। 

-“আহ্, আলোটা বন্ধ করো। চোখে লাগে। আচ্ছা তোমার কি চোখে ঘুম নেই গা, সারাদিন খাটাখাটনির পর একটু যে ঘুমোব তারও জো নেই। হে ভগবান, কার পাল্লায় যে পড়েছি !” চোখ বন্ধ করেই একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ওঠে মিতা। 

পাল্লায় পড়েছিলে বলেই টিকে আছ, আর সংযুক্তার মতো ভাগিয়ে আনিনি তোমাকে, রীতিমত সম্মন্ধ করে বিয়ে। কনে দেখতে গিয়েও হেনস্থার কম করেনি তোমার বাপ।”

নবতরু-ই-পত্রিকা 2021
নবতরু-ই-পত্রিকা

—”কী হেনস্থাটা হয়েছিল শুনি? যাওয়া মাত্রই গ্লাসভর্তি কমলালেবুর স্কোয়াশ দিয়ে শরবত। তিন তিনটে গ্লাস চুঁ-চাঁ করে মেরে দিয়ে পেট হয়ে গেল জলভর্তি জালা, এরপর যা এল মিষ্টি সন্দেশ বেগুনি চা এমনকি দুপুরের ঘিলু ভর্তি মাছের মাথাটাও দেখতে রুচি হল না। সব ষড়যন্ত্র, তোমার বাপের ষড়যন্ত্র।”

—”উঁ.. কী জুলিয়াস সিজার এলেন রে আমার, উনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে সবাই। কই হয়ে দেখাও কাকলির বরের মতো তো বুঝব। বিয়ের পর হতে কোন শখটা পূরণ করেছ আমার?”

এখানে এসেই আঁটকে যায় প্রকাশ । যা চাকরি করে তাতে স্ট্যাটাস মেনটেন করতেই কাছা খুলে যায়। তিনটাকার বেতনে আইটি ডিউটি ভাইটি করতে করতেই টিবি ধরে যায়। জীবন মানেই যন্ত্রণা। অবসর সময়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসে যে এতদিন চাকরি করে কি করলো সে। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র, টিভি, চেয়ার, বাসনপত্র, এমনকি অন্তর্বাস পর্যন্ত । রাগে দুঃখে গায়ের খাটের মশারিস্ট্যান্ডে টাঙানো জামাটাকে টেনে ছুড়ে মারে মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে মানি ব্যাগের সাথে বেরিয়ে পড়ে একটুকরো কাগজ। কাগজটা তুলে নিয়ে হো হো করে হাসতে থাকে প্রকাশ। 

—”কি গো পাগল টাগল হলে নাকি ? হাতে ওটা কী?” প্রকাশের হাসি শুনে বিছানার উপর উঠে বসে মিতা। 

কোনও উত্তর দেয় না প্রকাশ। উত্তর দিলে দক্ষযজ্ঞ হবে। তাতে সতী নয়, হরের সাথে দক্ষ রাজারও পূর্ণাহুতি হবে। তবে কাঁধে তুলে নাচার মতো কেউ থাকবে না। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো ‘মজাসে খাও’ রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে হবে। ঘুমোতে হবে গ্রীলের বাইরে বারান্দায়। 

কাগজটাকে ভাঁজ করে পকেটে ভরে নেয় প্রকাশ। নষ্ট করে ফেলা উচিত নয়। ন্যায্য পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কাটা রসিদ। মোটা টাকা মোটা অক্ষরে লেখা ‘উৎপীড়িত পতি পরিষদ’।

একটা টিনের চালার সামনের দিকে একটা রংচটা টিনের বোর্ড, বোর্ডের উপর লেখা শব্দ কয়টি। সেদিন বাজার হতে আসার পথে সাইনবোর্ডটা নজরে পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়ল প্রকাশ। একবার ঢুকেই দেখা যাক। একই উদ্দেশ্যে কতগুলো লোক সমবেত হলে তাকেই সঙ্ঘ বলে। যত রাজ্যের বৌয়ে খেদানো লোক যখন একজোট হয়েছে তখন কিছু তো একটা সুফল মিলেছেই। 

গীতাতে ভগবান বলেছেন ফলের আশা না করে কর্ম করে যেতে। আজ দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে যে বেলগাছের যত্ন করে চলেছে প্রকাশ তার ফল মিলছে বিল্বপতনের মাধ্যমে। হাতা বেলনা ঝাঁটা, – ফ্রুটফুল এফেক্ট । না, এসবের কানাকড়িও আশা করেনি সে। সে বরাবরই ‘মা ফলেষু কদাচন’।

খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল প্রকাশ। দেওয়াল লাগোয়া একটা টেবিল, টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র, চায়ের কাপ, নীল রঙের জলের বোতল, অ্যাশট্রে আর ধুপদানি। টেবিল লাগোয়া খান তিনেক চেয়ার। এর মধ্যে দুটো চেয়ার দখল করে বসে আছেন দুইজন ভদ্রলোক। উৎপীড়ীত পতিই হবে নিশ্চয়। এদের মধ্যে মাঝবয়সী ভদ্রলোক একটা পুরোনো খবরের কাগজে শব্দছক করছেন, আর অপর ভদ্রলোকটি তুলনায় বেশ বয়স্ক, ঘাড় গুঁজে সুখনিদ্রা দিচ্ছেন। 

প্রকাশের পায়ের শব্দ শুনেই খবরের কাগজওয়ালা ভদ্রলোক কাগজটা নামিয়ে রেখে প্রকাশের দিকে তাকালেন। চশমাটা নাকের উপরদিকে একটু তুলে বললেন, “কী চাই ?” 

—”সাইনবোর্ড দেখে এলাম।” 

—”ও, উৎপীড়িত পতি। তা ভালো। আমাদের কাজই হল স্ত্রীর হাতে অত্যাচারিত স্বামীদের উদ্ধার করে পুনর্বাসন করা। অনেকটা পশুপ্রেমী সংগঠনরা যেমন করে আর কি।”

—”মানে পথকুকুরদের সঙ্গে তুলনা করছেন?” ক্ষোভের সঙ্গে বলল প্রকাশ। 

ভদ্রলোক একটা মিষ্টি হাসি হেসে বললেন,”আরে না না, রেগে যাবেন না। সেরকভাবে বলিনি। পতি আর পটির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই মশাই। একটু বাসি হলেই পরিত্যক্ত হয়। স্থান হয় ঘরের বাইরে। সেদিন আর নেই রে ভাই, যুগ পাল্টেছে। অর্ধনারীশ্বর পাশফিরে শুয়েছেন। ‘নারী চাপা ছিল এতদিন,আজ চাপা পড়িয়াছে নর!'” কাব্য করলেন ভদ্রলোক। 

পাশের ফাঁকা চেয়ারটাতে বসল প্রকাশ। ভদ্রলোক ড্রয়ার হতে একটা রসিদবই বের করতে করতে বললেন, “নতুন সদস্য মাত্র পঞ্চাশ টাকা, মাসে মাসেও ওই একই। সদস্যদের কারোর সমস্যা হলে, মানে বউ অত্যাচার করলে একত্রিত হতে হবে। অনশন, ধর্না, থানায় স্মারকলিপি দেওয়া, – এগুলো আমাদের সমিতির অঙ্গ। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, সঙ্ঘশক্তিই আমাদের বল। ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড ডিভাইডেড উই ফল। “চড়চড় করে পঞ্চাশ টাকার রসিদ লিখে প্রকাশের হাতে ধরিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। 

রসিদটা পকেটে ভরতে ভরতে প্রকাশ বলল,”তাহলে আসি।”

ভদ্রলোক পাশের বয়স্ক ভদ্রলোককে ঠেলা মেরে বললেন,”ও মিত্তিরদা, নতুন সদস্য এসেছে গো, একবার আলাপ পরিচয়টা করে নেবেন না? ও মিত্তিরদা ?”

‘অঁ-অঁ’ শব্দ করে মাথা তুললেন মিত্তিরদা। চোখ কচলে নিয়ে তাকালেন নতুন সদস্যের দিকে। তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন। প্রকাশও আঁতকে উঠে বলল, “বাবা আপনি…?” 

মিত্তিরদা ঢোঁক গিলে যে কি বললেন তা বোঝা গেল না। পাশের ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন,”মিত্তিরদাকে চেনেন ? ইনিই আমাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।”

প্রকাশ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, উনি আমার শ্বশুরমশাই।” 

ভদ্রলোক কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। কানে লাগিয়ে বললেন, “কে লতিকা ?…. তোমার খাওয়া হয়ে গেছে ?….. হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি। মোটে তো ওইকটা বাসন, হ্যাঁ কাপড়গুলোও এ-বেলাই কেচে দেব।”

হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। আর মিত্তিরদা ওরফে প্রকাশের শ্বশুরও সঙ্ঘের ঝাঁপ ফেলে বেরিয়ে পড়লেন। প্রকাশও সঙ্গ নিল শ্বশুরের। পাশাপাশি শ্বশুর জামাই চলেছে বড়রাস্তা দিয়ে, যেন একই চিটফাণ্ড কোম্পানির হাতে ঠগে যাওয়া দুই আমানতকারী। পেছনে মধ্যগগণমুখী সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে একটা সাইনবোর্ড। তার কালো মোটা অক্ষরের লেখাগুলো ক্রমশ ছোট আর অস্পষ্ট হয়ে আসছে। 

Author

  • সুব্রত মজুমদার

    তরুণ সাহিত্যিক তথা গল্পকার সুব্রত মজুমদার বীরভূম জেলার চন্দ্রপুরে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। এরপর ডেউচা গৌরাঙ্গিনী উচ্চবিদ্যালয় ও পরবর্তীকালে সিউড়ি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ ও সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক স্তরের শিক্ষালাভ করেন। পেশায় শিক্ষক শ্রীমজুমদার বর্তমানে বীরভূম জেলার মল্লারপুরে বসবাস করেন। লেখালেখি ছাড়াও ভালোবাসেন বই পড়তে; উদ্যানচর্চাতেও বিশেষ আগ্রহ আছে তাঁর। কবিতার মাধ্যমে তাঁর লেখালেখি শুরু হয়। একটা ওয়েবম্যাগাজিনে 'বিক্রম গোয়েন্দা'র কাহিনি প্রথম স্বরচিত গল্প। এরপর 'বগলা ভটচাযের গল্প', বিক্রম গোয়েন্দার মতো সিরিজ় সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হল— বগলা ভটচাযের গল্প(২০১৯) বগলা উবাচ, প্রথম খণ্ড(২০১৯) বগলা উবাচ, দ্বিতীয় খণ্ড(২০২০) জলতরঙ্গ(২০২০)

3 thoughts on “উৎপীড়িত পতি পরিষদ: সুব্রত মজুমদার

  1. নবতরুকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই লেখা প্রকাশের জন্য।

  2. গল্পটা পরে একটা গানের লাইন মনে পড়ল, ” কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়” , সত্যিই জীবন যে রঙ্গমঞ্চ তারই হাস্যরসিকতাময় গল্পকথা । দারুন। এমন লেখা কার না ভালো লাগে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ছোটো গল্প

বোকার চালাকি: সৌমেন দেবনাথ

    দেখতে যেমন বোকা বোকা, কথাবার্তায়ও তেমন বোকা বোকা। কাজে-কর্মের ধরণ-ধারণেও বোকামি বোকামি ভাব। চলন-বলনেও বোকা বোকা দেখতে লাগা মানুষটার নাম আক্কাস। সহজ-সরল আর আলাভোলা এই লোকটাকে নিয়ে আমরা যথেষ্ট  মজা-মশকরা করি। যখন মন চায় তখনই তাকে ডেকে নিয়ে যেদিক সেদিক চলে যাই।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    Nabataru-e-Patrika-2023-9.jpg
    ছোটো গল্প

    কলার বাকল: রানা জামান

      জাবের ও নাভেদ বের হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ভ্রমণে। ওরা চলে গেল নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায়। সাদা সিমেণ্ট দেখবে। বাংলাদেশের আরেক মূল্যবান খনিজ; চিনামাটির তৈজসপত্র তৈরি করা হয়। পাহাড়ি এলাকায় ঘুরাঘুরি করতে ওদের বেশ লাগছে। ছোট ছোট পাহাড়ে উঠে ছবি তুলছে দেদার, সেল্ফিও নিচ্ছে। সকাল এগারোটা বাজছে। খিদে খিদে ভাব অনুভব করছে পেটে। চা পানের […]

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      ছোটো গল্প

      মানসী: তুলি মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী

        হঁ বাবু, যে শরীর তুকে শান্তির ঘুম দেয়, একটা ছবি থাকবেনি তার! কুতোওও ছবি তুর আঁকা, বিকোয় দেশ বিদেশ, একটা লয় ইখানেই থাইকবে, মাটির ঘরে

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন