আজ কত বছর পর ত্রয়ী মেয়ের হাত ধরে সেই চেনা রাস্তা ধরে যাচ্ছে। এই সেই গ্রামের রাস্তা। কত স্মৃতি বিজড়িত এই জায়গা। চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ সেই চেনা পুজো পুজো গন্ধ, নতুন জামা কাপড় পড়া কচিকাঁচাদের ছোটাছুটি, এই সেই দুর্গামণ্ডপ। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় ত্রয়ীর। এখানে পুষ্পাঞ্জলির জন্য ভিড় করত তারা দল বেঁধে। বলিদানের সময় ভয়ে লুকিয়ে পড়ত সে আড়ালে, বলিদান সে দেখতে পারত না কোনদিনই। আরতির সময় ধুনুচিতে বেশি করে ধুনো দিতো সে, যাতে এই সময় পুজোর ঘর পুরো ধোঁয়ায় ভরে ওঠে। পুষ্পাঞ্জলির সময় যতটা হাত বাড়িয়ে ফুল ছোড়া যায় ছুড়ত সে, যাতে ফুল মায়ের পায়ে পৌঁছোয়। সে ব্রাহ্মণ কন্যা, ছোট থেকেই সে তার বাবা-কাকাকে দুর্গাপুজো করতে দেখেছে। পুজোর শেষ পর্বে তার বাবারা যখন পুজোর পাওনা সামগ্রী নিয়ে বাড়ি আসত, তার নজর থাকত পুজোয় পাওয়া মায়ের হাতের লোহাগুলোর উপর। সুন্দর সুন্দর লোহাগুলো কখন সে হাতে পরবে ভেবেই সে খুশি হয়ে যেত। আর কুমারী পুজোর স্মৃতিও তার চোখের সামনে ভাসে। সেই পালা করে তিন বোনের কুমারী হওয়া, উপহার স্বরূপ এক বাক্স সাজ তিন বোনের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া, সেই কেয়োকার্পিন তেলের সুগন্ধ, কুমকুমের মিষ্টি গন্ধ আজও তার নাকে ভাসে। বিদায়বেলায় বরণের সময় মায়ের বিষণ্ণ দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা, জামায় চোখ মুছতে মুছতে মাকে এগিয়ে দেওয়া, বিসর্জনের পর একটু জল ছিটানো, এগুলো কখনোই সে ভুলতে পারে না।
অতীতের স্মৃতিচারণায় ত্রয়ী এতই ব্যস্ত ছিল যে, সে খেয়াল করতে পারেনি কখন সে মন্দিরের লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সে তার বৃদ্ধা ঠাকুমাকে বসিয়ে রেখেছিল। আজ ঠাকুমাকে প্রায় একপ্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছে সে। আজ বহু দিনের এক মনের ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। ছেলেবেলায় ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছিল—এক চোদ্দো বছরের মেয়ে কৃষ্ণা, তার ভাইয়ের হাত ধরে ছুটেছিল এই মণ্ডপের দিকে। সেখানে তখন বিশাল লাইন, বহু হতদরিদ্র মানুষের ভিড়। একটি কাপড় ও এক কেজি চালের জন্য বহু মানুষ সকাল থেকে ভিড় করেছে। গ্রামের এক বিশিষ্ট মানুষ প্রতি বছর এই দিনে গরীবদের এভাবেই কিছু না-কিছু দান করেন। সেই ছোট্টো মেয়েটির আশা পূরণ হয়নি। তার পালা আসার ঠিক আগেই সব কাপড় ফুরিয়ে গিয়েছিল। সে ছুটতে ছুটতে মায়ের কাছে এসে বলেছিল,“ওরা আমায় একটাও কাপড় দিল না মা।”

মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,“কাঁদিস না মা, পরের বছর আমি তোকে একটা নতুন কাপড় কিনে দেব।”
এই গল্পটি বলতে গেয়ে ঠাকুমাকে বহুবার কাঁদতে দেখেছে সে। কারণ সেই কৃষ্ণাই ছিল ত্রয়ীর ঠাকুমার মেয়ে অর্থাৎ পিসি। ঠাকুমা তার ছোট্ট মেয়ে কৃষ্ণাকে কোনোদিনই আর ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারেননি। কৃষ্ণা মাত্র ষোলো বছর বয়সেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছিল। ছোটো থেকেই ত্রয়ীর স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে চাকরি পেয়ে গরিব ছেলে মেয়েদের জন্য প্রতি বছর নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে। ত্রয়ীর এই ছোট্ট প্রয়াস তার ঠাকুমার পুরোনো ক্ষতে যদি একটু প্রলেপ দিতে পারে, তার জন্য এবারের পুজোয় তার গ্ৰামের বাড়িতে আসা।
হঠাৎ ঢাকের আওয়াজে ত্রয়ীর চেতনা ফিরল, সে দেখল তার সামনে এক লম্বা লাইন আর অগণিত মানুষের ভিড়; তবে আজ এইসব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিয়েছে সে নিজে। সে সামনে এগিয়ে গেয়ে দেখল তার ছোট্ট মেয়েটি একটা একটা করে শাড়ি, জামাকাপড় ঠাকুমার হাতে তুলে দিচ্ছে আর তার ঠাকুমা নিজের হাতে প্রতিটি মানুষকে এগুলি সযত্নে দান করছেন। ঠাকুমার মুখে হাসি থাকলেও চোখের কোনায় এক বিন্দু জল তার নজর এড়িয়ে যেতে পারেনি। এই চোখের জলের মানে সে বোঝে। অনেক বছর আগে সেই চোদ্দো বছরের মেয়েটি শূণ্য হাতে কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিল। ঠাকুমা বোধহয় তার দেওয়া কথা রাখতে পারেনি, অভাবের সংসারে ভালো শাড়ি কোনদিনই কিনে দিতে পারেনি। আজ তাদের অভাব-অনটন ঘুচে গেছে, তাদের খাওয়া-পরার অভাব নেই। এখন কত নতুন নতুন জামাকাপড় আসে ঠাকুমার জন্য তার ছেলেদের জন্য। শুধু ঠাকুমার চোখে শূন্যতা, সব পাওয়ার মাঝে না পাওয়ার বেদনা। এগুলো কেউ না বুঝলেও সে বোঝে।
হাসি মুখে প্রতিটি মানুষের চলে যাওয়া দেখতে থাকে সে আর দেখে ঠাকুমার মুখে এক অনাবিল তৃপ্তির হাসি। সে খেয়ালই করতে পারে না কখন যে তার ছোট্টো মেয়েটি তার কাছে এসে দাড়িয়েছে আর তাকে জিজ্ঞাসা করছে,“মা তুমি কাঁদছ কেন? আজ তোমার কত দিনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, তুমি খুশি হওনি?”
ত্রয়ী আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আকাশ জুড়ে একটা মেয়ের মুখ। সে যেন হাসছে আর ঠাকুমার উদ্দেশে বলছে, “আমি খুব খুশি হয়েছি মা। আজ আর কোনও কৃষ্ণাকেই শূন্য হাতে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরতে হয়নি, কোনও মাকেই তার মেয়েকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে না-পারার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। তুমি ভালো থেকো।”
ত্রয়ী তাকিয়ে দেখে লাইন প্রায় শেষ, সব লোক জামাকাপড় নিয়ে চলে গেছে। সে তার ঠাকুমাকে বলে, “চলো ঠাকুমা, আমাদের এখানকার কাজ শেষ, বাড়ি চলো।”
এক হাতে মেয়েকে অন্য হাতে ঠাকুমার হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির পথে রওনা হয় ত্রয়ী।