Recent Post

আলো-আঁধারি

আলো-আঁধারি(১ম পর্ব) -বরুণ মুখোপাধ্যায়

বরুণ মুখোপাধ্যায়, ছবি_ gettyimages.in

আজ সপ্তমীর সকালবেলায় গোলাপী শাড়িটার সঙ্গে আর যে যে জিনিস পরবে সেগুলো একপাশে রেখে আগামী তিনদিনের জন্যই বাকি শাড়িগুলোও বেছে নিয়েছে রক্তিমা। বরের কাজের চাপ এবং বাড়ি আসার সময় তারিখ ঠিকঠাক না থাকায় এবার পুজোর অনেক আগেই ওরা মার্কেটিং করে নিয়েছে। আগামীকাল মহা অষ্টমীর জন্য সে সবচেয়ে ভালো শাড়িটা বারকয়েক দেখে আবার আলমারির ভিতরেই রেখে দিল যেমন ছিল তেমন অবস্থায়। আগে থেকে বেছে নিয়ে ঠিকঠাক করে না রেখে দিলে কাজের সময় হঠাৎ করে হাতের কাছে খুঁজে পাওয়া নাও যেতে পারে। এইটা রক্তিমার অভ্যাস আর এই বিষয়ে সে পরিচিত মহলে অনেক প্রশংসা পায়। মেজ-কাকিমা তো একদিন কথায় কথায় সকলকে একপ্রকার শুনিয়েই বলে দিল, “এইরকম গোছালো বউ যদি আমার ঘরেরটা হত, তবে নিশ্চিন্তে মরতেও পারতাম! আমার ভাগ্যে কি আর তেমন কিছু আছে?” 

রক্তিমা ভিতরে ভিতরে কিছু একটা ভাবলেও এইরকম কথায় কিছুই বলার থাকেনা ওর। এখন এই কথা মনে পড়ে যাওয়াতে সুপ্রিয়ার জন্য রক্তিমার সত্যি সত্যিই খারাপ লাগে। সুপ্রিয়া ওর সম্পর্কীয় জা।

ঠিক তখনই শাশুড়ির কথায় মনে পড়ে গেল স্নানের পর তাড়াহুড়োয় ভিজে জামাকাপড়গুলো বালতিতেই রয়ে গেছে। 

-“বউমা, তোমার ওগুলো কি মেলে দেব?”

শাশুড়ি সবসময়ই এইসময়টা খুব তাড়া দেন, সকাল সকাল নিজে না খেলেও বউমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে রাখেন। ঠাকুর পুজো করে খেতে নিতে একটু দেরি হবে বলে ছেলের বিয়ের পর পরই বউমাকে বিষয়টা বলে রেখেছিলেন। কোনও রকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বরকে একবার ফোন করতে গেল রক্তিমা। আসলে এই সময়টায় ফোন না করলে আর পাওয়া যায় না। কাজে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাত্রে। লকডাউনের পর কাজের চাপ বেড়েছে অনেকটাই। কিন্তু তাড়াহুড়োয় ফোন আর করা হল না।

-“না মা, আমি যাচ্ছি…” বলে রক্তিমা ভিজে কাপড় মেলতে যায়।

আজ গোলাপী শাড়িটা পরে কোনওরকমে বেরিয়ে এসে দেখে বাইরে মেঘলা রোদ। সপ্তমীর সকালে এমনটা না হলেই ভাল হত। কাপড় মেলার পর ক্লিপ লাগাতে গিয়ে মেজ-কাকিমার ছাদে সুপ্রিয়াকে দেখল রক্তিমা। অনেকদিন যত্ন না নিলে চোখেমুখে যে বিষন্নতার ছাপ ফোটে, সুপ্রিয়াকে দেখলে সেটা স্পষ্ট হয়। অথচ সুপ্রিয়ার জন্য কিছুই করতে পারেনা সে, হোয়াটসঅ্যাপ-এ কথা হয় ঠিকই কিন্তু চোখের দেখা হয় কম। মায়া মায়া মুখটা মনে পড়লে বড় কষ্ট হয়।

রক্তিমার আভা ছড়িয়ে পড়ে তার সারা অঙ্গ জুড়ে। তারে মেলা জামাকাপড় দেখে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে তার সুখ সমৃদ্ধির কথা। নিত্যনতুন ডিজাইনের ভেজা জামাকাপড় অল্প হাওয়ার দোলাতেই কেমন শুকিয়ে যায়। আর অন্যদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর থেকে সন্ধে নামলেও শুকায় না সুপ্রিয়ার চোখের পাতা।

আসলে কিছু মানসিক সমস্যার জন্য সুপ্রিয়া সব কিছু মনে রাখতে পারেনা। তার এই সমস্যা সমাধানে তার বাড়ির কেউ এগিয়ে আসেনা, কেউ যত্ন করে কথা বলেনা। একদিন রক্তিমার কথাতেই ওর বাপের বাড়ির লোকজন ডাক্তারের পরামর্শ নেন, সামান্য ওষুধপত্র দিলেও এই সমস্যার যে চটজলদি সমাধান নেই সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন ডাক্তারবাবু। তবে তাকে সব বিষয়ে উৎসাহিত করলে হয়ত খানিকটা আত্মবিশ্বাসী হবে আর তাতে সমস্যাটা কমেও যেতে পারে এটা ডাক্তারবাবু বুঝিয়ে বলে দেন তাদের। সময় মত ঠিকঠাক কাজ না করতে পারায় সকলেই বিরক্ত হয়, কেবল ওর বর ছাড়া; কিন্তু সেও তো আর সবসময় কাছে থাকেনা। অবশ্য এখন কাজ হারিয়ে এই কয়েক মাস তার বর বাড়িতেই বসে। এই নিয়ে তাকে শাশুড়ির কথাও শুনতে হয়। তার জন্যই নাকি তাঁর ছেলের এই ভাগ্যমন্দা। এই কয়েকমাস তার বর সকালের খবরের কাগজ বিক্রির কাজ করে। অভাবের সংসারে নিজে কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা সুপ্রিয়াকে কুড়ে কুড়ে খায়। বাড়ির লোকেদের বিরক্তির কারণ যে ও নিজে এ কথা ভেবে আড়ালে চোখের জল ফেলে।

-“আজও কি ছাদেই বসে থাকবে বউমা? নেমে এসো, দেখো কত কাজ পড়ে আছে, সেরে নিয়ে তো একবার ঠাকুর বাড়ি ঘুরে আসতে পারো।” সুপ্রিয়ার শাশুড়ি অর্থাৎ মেজ-কাকিমার ডাকে সম্বিৎ ফেরে রক্তিমার, দেখে শাশুড়ির কথায় সুপ্রিয়া ছাদ থেকে নীচেয় নেমে যায়।

পুজো মণ্ডপে অল্প মানুষজনই আছেন, বেশিরভাগ মহিলা। সকালে নবপত্রিকার আগমনে যে ভীড় ছিল তা এখন অনেকটাই কম। মন্দিরে ঢুকেই রক্তিমা পুজোর ডালি সাজিয়ে আনা নৈবেদ্য নামিয়ে রাখে পুরোহিতের পাশেই। ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে নিজেও বসে আরও সব মহিলাদের সঙ্গেই। পুজোর উপাচারের গন্ধের সঙ্গে দামি পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গোলাপী শাড়ি আর নীল ব্লাউজের সঙ্গে প্রিন্টেড মাস্ক মুখ ঢাকা রক্তিমাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছিল। কখন যে তার পাশে সুপ্রিয়া এসে বসেছে তা ও টেরই পায়নি। আসলে সবটুকু রঙই তো রক্তিমাই মেখে নিয়েছে, বাকি ছিটেফোঁটা অন্যান্য মহিলারা নিয়ে শেষ করেছে, তাই সুপ্রিয়ার জন্য আর কিছু খালি নেই। সুপ্রিয়াকে দেখা মাত্র রক্তিমা ওর কাছে গিয়ে বসে। ওর সঙ্গে কথা বলে যাতে সুপ্রিয়া একটু হালকা বোধ করে। পিঠে হাত দিয়ে সুপ্রিয়ার শাড়িটা ঠিকঠাক করে দিতে দিতে বলে,”আজ কিন্তু তোকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে, এমন করেই থাকবি রোজ, বুঝলি?”

-“তাই? … কিন্তু রোজ রোজ তো আর পুজো হবেনা দিদিভাই, তাই মন্দিরেও আসা হবেনা, আর তাছাড়া সারাদিন যা কাজ… সামলে ওঠাই মুশকিল!”

          (এরপর পরবর্তী সংখ্যায়)

Author

  • Barun@Mukherjee

    নবতরু ই-পত্রিকার সম্পাদক বরুণ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৮৪ সালে। বীরভূম জেলার নানুর থানার শ্রীকৃষ্ণপুরের গ্রামের বাড়িতেই বড়ো হয়ে ওঠেন। আবাসিক ছাত্র হিসাবে বিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত করেন বিশ্বভারতীর পাঠভবন ও উত্তর শিক্ষা সদনে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ বরুণ মুখোপাধ্যায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ভালোবাসেন লেখালেখি করতে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক চর্চা ও সৃজনশীল কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে সর্বদা যুক্ত রাখেন। নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টির উন্মেষ ঘটানোর জন্যই দায়িত্ব নিয়েছেন নবতরু ই-পত্রিকা সম্পাদনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার (১/১২ পর্ব)
গদ্য- সাহিত্য গল্প ধারাবাহিক গল্প

আয়নাবন্দি: জিৎ সরকার

    গাড়িটা যখন বড়ো গেটের সামনে এসে দাঁড়াল তখন শেষ বিকেলের সূর্য পশ্চিমাকাশে রক্তাভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো সন্ধ্যেকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল
    গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

    শৈশবের গরমকাল: ঈশিতা পাল

      আমার শৈশব ভাড়াবাড়িতে। তাই গরমের ছুটিতে কাকু, জেঠুদের বাড়ি টানা একমাস ছুটি কাটাতে যেতাম। মামাবাড়িও যেতাম। ছেলেবেলার গরমকাল জুড়ে বেশ কিছু মজার স্মৃতি আছে

      বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন
      চাদিফাঁটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ
      গদ্য- সাহিত্য স্মৃতিকথা

      চাঁদিফাটা আমার সেকাল: বন্দে বন্দিশ

        মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার সেইসব দিন, প্রচন্ড গরম থেকে স্বস্থির আরাম

        বিশদে পড়তে এখানে ক্লিক করুন