আরও একবার(৫ম পর্ব): জিৎ সরকার
(আগের পর্বটি পড়ার জন্য ক্লিক করুন)
“দুঃখিত মিঃ রায়, আটচল্লিশ ঘন্টা না-কাটলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তাছাড়াও ব্লাড লস হয়েছে প্রচুর, কিডনি ছাড়া ভাইট্যাল অরগ্যানগুলো তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এটা আশার কথা। তবে পেশেন্ট ঠিক রেসপন্স করছে না চিকিৎসাতে, যেন বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে, এটা একটু ভাবাচ্ছে।” ডাক্তার সেন এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে একটু থামলেন, ফের বললেন- “আরও একটা খারাপ খবর আছে মিঃ রায়।”
সায়ক প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল ডাক্তারের দিকে। ডঃ সেন বললেন, “আপনাদের বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।”
কয়েকটা সেকেন্ড সায়কের বাক্যস্ফূর্তি হল না এই নতুন বিস্ময়ের ধাক্কায়। সে একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল কিন্তু ডা. সেনই বললেন, “আপনার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আপনি কিছু জানেন না এই ব্যাপারে। উনি হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না তাই হয়তো জানাননি, সুযোগ বুঝে ঠিকই বলতেন। ওয়েল, আই অ্যাম সো সরি মিঃ রায়!” বলেই ডা. সেন চলে গেলেন।
বিস্ময়ের ধাক্কাটা এতই জোরালো ছিল যে সায়ক শুধুই উদভ্রান্তের মতো চেয়ে রইল, একটুও শব্দ করল না। সবটা কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তার, অনুমিতা প্রেগনেন্ট! অথচ সে কিছুই জানল না। তবে কী…? তবে কী অনুমিতা তাকে বলতে পারেনি তাদের ভেতরে সমস্যার কারনে, না বলতে চায়নি; ইচ্ছাকৃত ভাবে চেপে গেছে কথাটা? সন্দেহের পোকাটা আবার নাড়া দিয়ে উঠল সায়কের মাথায়। বাচ্চাটা কী আসলেও তার? নাকি…নাকি অন্য কারো…রজত বোসের? নাঃ, আর ভাবতে পারছে না সায়ক, অথবা ভাবতে চাইছে না। কিছুক্ষন আগেও অনুমিতার জন্য যে দুঃখটা, খারাপ লাগাটা সায়ককে আছন্ন করে ফেলেছিল সেটা এখন রাগে পর্যবসিত হচ্ছে সাথে সাথে একটা ঘৃনাও যেন উঠে আসছে শিরদাঁড়া বেয়ে। সন্দেহের বীজ বড়ো বিষম বস্তু, একবার মনের মাটিতে বপন করা হলে মহীরূহের সৃষ্টি হতে বেশি সময় নেয় না।
সাড়ে চার ঘন্টা আগে সায়ক যখন অ্যাক্সিডেন্টের অকুস্থলে পৌঁছায় তখন সেখানে স্থানীয় জনতা, পুলিশ, মিডিয়া,
মেডিক্যাল টিম, মিডিয়া সব মিলিয়ে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। তনিমা তখন তার নিজের কাজটা তার জুনিয়রকে বুঝিয়ে দিয়ে পাগলের মতো খুঁজছে অনুমিতাকে। সায়ক গিয়ে যোগ দেয় তার সঙ্গে। ভাগ্যক্রমে তারা দুজন মিনিট দশেক পর অনুমিতাকে খুজে পায় রক্তাক্ত অবস্থায়। তখনও কিঞ্চিৎ জ্ঞান অবশিষ্ট আছে অনুমিতার, অস্পষ্ট আর ক্ষীণ স্বরে সে কী যেন বলছে একটা ঘোরের মধ্যে। সায়ক শুধু তার নামটা উদ্ধার করতে পারল ভাঙা ভাঙা কথাগুলোর মাঝ থেকে, বাকি পুরোটাই ঝাপসা। সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের নার্সিংহোমে অনুমিতাকে ভর্তি করাতে আরও আধঘন্টা। তারপর তার চিকিৎসা শুরু হয়, একটা অপরেশানও করা হয় তার। বিস্ময়কর ভাবেই ইনজুরির বেশির ভাগ অংশটাই দেহের ওপর আর কয়েকটা হাড়ের ওপর দিয়ে গেছে শুধু পেটে খুব জোরে একটা আঘাত লাগায় বাচ্চাটার ক্ষতি হয়ে গেছে আর অনুমিতা কিডনিও একটু ক্ষতিগ্রস্ত। তবে রক্ত বেরিয়েছে প্রচুর আর অনুমিতার শরীর বেশি রক্ত নিচ্ছে না। তাই অনুমিতার জ্ঞান এখনো ফেরেনি, আর এভাবে চলতে থাকলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। একে এই সমস্ত কথা তার উপর অনুমিতার প্রেগনেন্সি আর তাদের বাচ্চা নষ্টের বিস্ময়কর খবর, এসবে সায়ক কেমন যেন প্রথমে দুঃখে আর পরে অনুমিতার উপর ক্ষোভে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
মাথায় একটু হাওয়া লাগানো জন্য সায়ক একটু নার্সিংহোমের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়ায়। কাল সারাদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে, একটা ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। সায়ক দেখে একটু দূরে তনিমা দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। একটু আগে সে সায়কের সাথেই ছিল তারপর কোন ফাঁকে যে এখানে এসেছে সেটা সায়ক খেয়াল করেনি। সে এগিয়ে যায় তনিমার দিকে। তনিমা ফোন কাটলে সায়ক বলে ওঠে, “জানিস তনি, অনু প্রেগন্যান্ট ছিল, আর আমরা কেউ কিচ্ছু জানিই না! আমি, তুই, বাবা কেউ না। বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি রে। জানিস, আমার মনে হয় বাচ্চাটা আমাদের নয়, ওটা মনে হয় ওই লোকটার, দ্যাট ব্লাডি রজত বোস। ছিঃ! অনু এতটা নিচে নামতে পারল…?” একনিশ্বাসে কথাগুলো আউড়ে যাচ্ছিল সায়ক, তাই কথা বলার ঝোঁকে লক্ষ্যই করেনি তনিমার চোয়াল একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে। সে বলে ওঠে, “ছিঃ দাদা, তোর মানসিকতা এতো নিচু, আমি ভাবতে পারি নি।” একটু থেমে আবার বলে, “শোন, অনুদি প্রেগনেন্ট সেটা আমি জানি, যেদিন আমি গিয়েছিলাম বউদিকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে সেদিনই অনুদি আমাকে বলে কথাটা। আর আমাকে এটাও অনুরোধ করে যেন আমি কথাটা এখন তোকে না বলি, যাতে নতুন করে কোনো হাঙ্গামা না করিস। ও তোকেও বলতে চেয়ছিল কিন্তু তোর রাগের জন্য তোকে বলতে পারেনি।”

তনিমার মুখে একথাগুলো শুনে সায়ক চুপ মেরে গিয়েছিল। সে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে প্রশ্ন করল, “আমার জন্য, কেন?”
তনিমা ফের বলে উঠল, “হ্যাঁ রে তোর জন্যই। মনে করে দেখ, অনুদির জন্মদিনের দিন তুই ফেরার পর অনুদি তোকে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তুই সেদিন যে বাজটা ফেলেছিল অনুদির মাথায়, তাতে বেচারি ক্ষোভে অভিমানে কুঁকড়ে গেছিল। তাই তোকে কথাটা বলতে আর হয়তো রুচি হয়নি। এখন দেখছি তুই না জানলেই ভালো ছিল, তাহলে তোর মাথায় এই নোংরা চিন্তা গুলো আসত না।”
আবার বিস্ময়ের বাঁধ এতটাই ভেঙেছে যে সায়কের চোয়াল ঝুলে গেছে, তবুও আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে সে বলল “সেদিন অনুকে যা বলেছি সেটা ভুল বলতে চাস?”
এবার তনিমা যেন ফেটে পড়ল, বলে উঠল, “হ্যা ভুল, পুরোটা তোর মনগড়া। একজন বিবাহিত মেয়ে যদি স্বামীকে না বলে তার কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে রেস্তোরায় ডিনার বা লাঞ্চ করতে যায় কিংবা এক গাড়িতে অফিসে যায় কিংবা বিশেষ কোনো দিন উদযাপন করে তাহলেই খুব সহজেই ধরে নিতে হয় সে পরকীয়ায় লিপ্ত, তাই না? কেনো তার কি কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই? আচ্ছা ভেবে দেখ এত বছরে কাজের অজুহাতের জন্য তুই আর রুমি কতবার একসাথে লাঞ্চ বা ডিনার করেছিস, কতবার ওর ফ্ল্যাটে গেছিস, বাইরেও গেছিস একসাথে কতবার, সবটা কী সবসময় অনুদিকে জানিয়ে করেছিস? অনুমতি নিয়েছিস? তাও অনুদি কিন্তু কখনো তোর আর রুমির সর্ম্পক নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেনি শুধু একবার ছাড়া। কারণ ও তোকে বিশ্বাস করে। এবার বল, তোরটা যদি পরকীয়া না-হয় ওরটা কী করে হয়? অনুদি যেটা করেছে সেটা একাকীত্ব থেকে, কাউকে একটা আঁকড়ে ধরার জন্য। রজতদার সাথে অনুদির সর্ম্পক খুব ভালো বন্ধুত্বের, এর বাইরে আর কিচ্ছু না। আসলে তুই ছোটার নেশায় এতটাই ব্যস্ত যে তোর পাশের মানুষটা একটু একটু করে একা হয়ে যাচ্ছে সেটা তোর নজরে পড়েনি। তাই এটা যদি তোর ভাষাতে পরকীয়াও হয় তাতেও একা অনুদিকে দোষ দেওয়া যায় কী?”
ক্ষনপূর্বের বলা তনিমার কথাগুলো সায়কের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। যেন কেউ সপাটে কয়েকটা চড় কষিয়ে তাকে একটা ঘোর থেকে জাগিয়ে দিয়েছে । সে এখন নিজেকে দুষছে। তার এখন মনে হচ্ছে অনু তাকে বলতে চেয়েছিল পারেনি শুধু তার বোকামোর জন্য। এখন সবকিছুর প্রায় শেষপ্রান্তে এসে সায়কের মনে হচ্ছে তার হিসেবে অনেক অনেক গরমিল ছিল, তাই একটা জীবন আজ বিপন্ন আর অন্যটা শেষ হয়ে গেছে। সে জানত অনুমিতা বড্ড আভিমানী তার আরেকটু যন্তশীল হওয়া উচিত ছিল, আরেকটু সময় দেওয়া উচিত ছিল। আজ যদি অনুমিতা আর না ফেরে তার জীবনে তার প্রতিষ্ঠার কী দাম রইলো, কী দাম রইলো এত স্বাচ্ছন্দের, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় তার। জীবনে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ পাওয়ার নেশায় মগ্ন সায়ক কখন অনুমিতার থেকে দূরে চলে এসেছে তাকে একা করে দিয়েছে তা সে নিজেও বোঝেনি। স্বাচ্ছন্দের ভিড়ে অনুমিতার মুখের হাসিটা কখন মিলিয়ে গেছে তা আজ সায়ক মনে করতে পারছে না। বহুদিন পর তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করল। আজ মা থাকলে বেশ হতো, তার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে কাঁদতে পারত সে। আজ হঠাৎ সায়কের বাবার কথা খুব মনে হচ্ছে। সেই বাবা যার সাথে তার কোনোদিন মতের মিল হয়নি, যার পাশে বিগত কয়েকবছরে সায়ক একটু বসেও নি কিংবা তার কথার ভালো করে উত্তরও দেয়নি। আজ তার কথা কেন মনে হচ্ছে? মানুষ যখন সব হারিয়ে ফেলে তখন সে তার পুরোনো সর্ম্পক গুলোর কাছে ফিরতে চায়, তার শেকড়ের কাছে একটু আশ্রয় চায়, সায়কও তার ব্যতিক্রম নয়। সে তার বাবাকে ফোন করে, ও প্রান্ত থেকে কথা আসে, “হ্যালো”।
সায়ক কথা বলতে পারে না। ভেতরের কান্নাটা হঠাৎ ঠেলে বেরিয়ে আসে যেন।
আটচল্লিশ ঘন্টা পরে অনুমিতার জ্ঞান ফেরে। তবে তার সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় আরও চব্বিশ ঘন্টা পরে। আজ সায়কের বাড়ি আর অনুমিতার বাড়ি থেকে প্রায় সবাই এসেছে তাকে দেখতে আর এসেছে রুমি। রুমি এসেছে শুধুমাত্র একটা কথা বলতে, এটা হয়তো পরে বললেও হতো কিন্তু তার মনে হয়েছে এটা আজই বলা দরকার। ঘরের মধ্যে বেডের একপাশে রুমি অন্যপাশে সায়ক। অনুমিতা স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে। প্রথম কথা রুমিই বলল, “অনু, আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমিই অনেকবার তোমার আর সায়কের মধ্যে ঢুকেছি না বুঝে, তোমাদের ভুল বোঝাবুঝির জন্য খানিকটা আমিও দায়ী। তার জন্য আমি দুঃখিত। আর কিছুদিন পরে আমার বিয়ে তোমাকে থাকতে হবে কিন্তু।”
অনুমিতা তাও নির্বাক। সে বেরিয়ে গেলে অনুমিতার চোখ সায়কে দিকে ঘুরল। ভাঙা স্বরে বলল, “আমাদের বাচ্চাটা, রাখতে পারলাম না।”
তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সায়ক তার একটা হাত নিজের হাতে ধরে বলল, “জানি, আমি সবটা জানি। একটা খুব বড়ো ভুল হয়ে গেছে। অনু আর একটা সুযোগ কী দেওয়া যায়? সব ভুলে, শুধু একটা সুযোগ। আবার সব নতুন করে শুরু করব আমরা, আরও একবার…।”
অনুমিতার চোখের জল বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেল, সে উপর নিচে মাথা নাড়ল শুধু।
বাইরে নবমীর সকাল, কিছুক্ষণ হল ক্ষীন ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। পুজো প্রায় শেষ। কাল হয়তো দেবী বিসর্জনের সাথে সাথে ওদের সব দ্বেষ, সন্দেহ মুছে যাবে। ওদের সর্ম্পক পাবে নিষ্কলঙ্ক একটা শরতের সকাল; একটা নতুন সুযোগ; আরও একবার…।
(সমাপ্ত)